বাংলাদেশের নয়ের দশকের শক্তিমান কবি মাহবুব কবির এবং একই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার অধিবাসী ছোটকাগজ সম্পাদক ও কবি সঞ্জয় সাহা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে
তাদের দুজনের দুটি কবিতাগ্রন্থের পাঠ-মুগ্ধতা জানিয়েছেন দুই বাংলার দুজন কবি ও লেখক।
সময়ের জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখিত দুই বাংলার দুই কবির দুটি
কবিতাগ্রন্থের পাঠ-মুগ্ধতা অন্য রেখার পাঠকের জন্য প্রকাশিত হলো। - বি. স.
প্রসঙ্গ : নির্বাচিত কবিতা
প্রবুদ্ধসুন্দর কর
মাহবুব কবির। নয়ের দশকের এই কবিরের দোঁহা আমি ‘লোক’ সাহিত্যপত্রে প্রথম পড়ি বছর তিনেক আগে। জেগে ওঠে অপরাধবোধ; গ্লানি। এত দেরি হয়ে গেল কবিরের কাছে যেতে! পরের বছর একুশের বইমেলা চষে তুলে আনি তাঁর ‘কৈ ও মেঘের কবিতা’ আর ‘ফুলচাষি মালি যাই বলো’ কবিতার বই দুটি। কবিরের বস্তুপৃথিবীর ভাববিশ্বের ভেতর আমার অনুপ্রবেশ ঘটে যায়। ‘বেসরকারি কবিতা’ আর ‘আয়নার দিকে’ হাতে আসেনি তখনো।
‘প্রকৃতির যে মানুষ, আর মানুষের যে এগিয়ে চলা— তাতে অপার এক স্বপ্ন আছে, সত্য আছে। অসীম যাত্রার আনন্দ আছে, দুঃখ আছে, ব্যর্থতা আছে, জয় আছে।
অহরহ মৃত্যুর মাঝেও কবিতা আমাকে পরাজিত হতে দেয় না। পরাজয় শেখায় না।’ মাহবুব কবিরের এই ‘সলিলকি’ উচ্চারিত হয় এক অন্ধকার অপেরায়। বাংলা কবিতার বাংলাদেশ বলতেই আমাদের যে পাঠের অভিজ্ঞতা এতদিন গড়ে উঠেছে তা থেকে অন্যতম কক্ষচ্যুত এই কবি। চড়বঃৎু রং হড়ঃ ধ ঃঁৎহরহম ষড়ড়ংব ড়ভ বসড়ঃরড়হ— এলিয়টের সিদ্ধান্তে আস্থাশীল কবিরের কবিতায় ক্লেদাক্ত জেলির মতো গড়ানো আবেগ নেই। মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সঙ্ঘ, রাজনীতি, আগ্রাসন, ইত্যাকার আবহ নিয়েই যেন জুয়ার টেবিলে সর্বস্ব হারিয়ে এক কবি এলোমেলো মাতাল চেয়ারগুলোর সঙ্গে একা একা চুটিয়ে খেলছে।
মাহবুব কবিরের লিখনভঙ্গিমা আপাতনিরীহ মনে হলেও প্রতিটি কবিতাই চাপা শ্লেষের গন্ধক দিয়ে তৈরি বিস্ফোরকে ঠাসা। সংস্কারক নয়, কবিরের ভূমিকা এক ক্ষতপ্রদর্শকের।
নিজেকেই চাবকে চাবকে মেদহীন, বাহুল্যহীন, বাকশাসিত এক ভাববিধায়ক কাব্যভাষা দিয়ে বস্তুপৃথিবীকে কবির উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃত কবির স্বপ্নের মতোই এক অভয় পৃথিবী মাহবুব কবির চেয়েছিলেন। ৎ
প্রসঙ্গ : ভাসাবে দোঁহারে
বিনয় বর্মন
সঞ্জয়দা’র কাব্য ‘ভাসাবে দোঁহারে’ অনেক দিন আগেই হাতে পেয়েছিলাম। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে পড়া হয়ে ওঠেনি। আজ যখন বইয়ের র্যাক থেকে বের করে পড়তে লাগলাম, খুব ভালো লাগল। সমগ্র কাব্যজুড়ে সঞ্জয়দা যেন নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তাই বিভিন্ন কবিতার শিরোনামে এবং চরণে চরণে গীতবিতানের নীরব সুর ধ্বনিত হয়েছে।
২৪টি কবিতার সমষ্টি এই কাব্য। একটু নীরবতা, একটু উচ্ছ্বাস, একটু আশা, উত্তেজনা আর কামনা নিয়ে এক একটি কবিতার জন্ম। এ কামনা মানসিক কামনা— ‘যে অগ্নিস্নানের ভিতর দিয়ে তুমি আসো/আমি তার তাপ বুঝি কিছু/আমাকে ও আগুন পোকা দাও, লোফালুফি করি।’
অথবা :
‘উৎসমুখে আলো
উৎসমুখে গান
তোর রাত্রিজুড়ে নদী
আমার বুকে দাঁড়ের শব্দ ছলাৎ ছল।’
কোনো কবিতায় সম্পর্কের বাস্তবতার কথাকেও কবি সঞ্জয় সাহা তুলে ধরেছেন- ‘প্রতিটি সম্পর্কে কিছু মদ মিশে থাকে/তার নেশায় বুদ হয়ে থাকি আমরা।’ কখনো বা ডাক দিয়েছেন কোনো সকালের রোদ্দুরকে-
‘ফোঁটা ফোঁটা রোদ
টুকরো টুকরো রোদ
ছুঁয়ে ছুঁয়ে চল যাই রোদের সমুদ্রে।’
সঞ্জয়দা কবিতার শিরোনামে ‘গীতবিতানের’ কিছু চরণ ব্যবহার করলেও কবিতার মধ্যে দিয়েছেন এক অন্য সুরের স্বাদ। সমগ্র কাব্যটি অন্যভাবে উপভোগ করলাম। ৎ