নাগেশ্বরীর মৃৎ শিল্পগুলো এখন মৃতপ্রায়

ছবিতে কৌশলী হাতে পরম খেয়ালে মাটির পণ্যটির যত্ন নিচ্ছেন রত্না রানী পাল। ছবিটি নাগেশ্বরীর গাবতলা কুমারপাড়া থেকে তোলা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

নাগেশ্বরীর মৃৎ শিল্পগুলো এখন মৃতপ্রায়

  • নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার মাটির তৈরী শিল্পগুলো এখন মৃতপ্রায়। বহুমূখী সমস্যায় জর্জড়িত ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি বিজ্ঞানের জয় যাত্রায়-প্রযুক্তির উন্নয়নে, অ্যালমুনিয়াম, কাঁচ ও প্লাষ্টিকের নিত্য নতুন শিল্প সামগ্রীর প্রসারের কারণে ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা, অনুকূল বাজারের অভাবে এই শিল্পটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। ভাল নেই এ শিল্পের কারিগরেরাও।

এক সময় মৃৎশিল্পী তথা এ শিল্পের কারিগররা তাদের কৌশলী হাতের নরম ছোঁয়ায় তৈরী মাটির শিল্পগুলো গৃহস্থলীর সকল প্রয়োজন মিটিয়ে শোভা পেত গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে-ঘরে। কুমারপাড়ার নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরীরা সবাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকত মাটির জিনিসপত্র তৈরীতে। তাদের তৈরী পণ্যগুলো ব্যবহৃত হত খেলনাসহ কৃষিতেক্ষেত্রেও। কিন্তু প্রযুক্তির এ যুগে কুমার পাড়ায় আর সে সব চিত্র চোখে পড়েনা! পাড়াগুলোতে এখন আগের মত প্রাণচাঞ্চল্যতা নেই,নেই কর্মব্যস্ততা। সময়ের বিবর্তণে প্রযুক্তির যাঁতাকলে আজ ঐসব মাটির তৈরী জিনিসপত্রের পরিবর্তে প্রতিটি পরিবারের ঘরে-ঘরে শোভা পাচ্ছে অ্যালমুনিয়াম,কাঁচ ও প্লাষ্টিকের রকমারি পণ্য। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরী এ পণ্যগুলো তুলনামূলক ভাবে ভাল মান ও টেকসই হওয়ায় তার সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছেনা পরিবেশ বান্ধব প্রাচীনতম এ মৃৎশিল্পটি। শুধু তাই নয়-জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে নদী,খাল-বিল ভরাট হওয়ায় মাটি সংগ্রহ ও জ্বালানী সহ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং সে অনুপাতে বিক্রয় মুল্যে মিল না কারণে এ মৃৎশিল্পটি একটি অলাভজনক পেশায় পরিণত হচ্ছে দিনদিন। তাই জীবন ও জীবিকার তাগিদে আস্তে-আস্তে এ পেশাটি ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিচ্ছে মৃৎশিল্পের শিল্পীরা। অপরদিকে আজো কেউ কেউ বাপ-দাদার এ পেশাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া সকল প্রকার সমস্যার সাথে যুদ্ধ করে। ফলে,খেয়ে না খেয়ে কোনমতে দিনাপাতি করতে হচ্ছে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে।

সরেজমিনে উপজেলার নাগেশ্বরীর ভিতরবন্দ কুমারপাড়া,বলদিয়া পালপাড়া ও কচাকাটার গাবতলা কুমারপাড়া ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সরেজমিনে কিভাবে আছেন-কেমন আছেন এ মৃৎশিল্পের শিল্পীরা- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কচাকাটার গাবতলা কুমার সম্প্রদায়ের এক পরিবারের চার সন্তানের জননী রতœা রানী পাল এ বুক হতাশায় নিয়ে বলেন- কিভাবে আর থাকমু দাদা,গরীবের ভরা ভগবানো সয়না! কিন্ত কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন- ভগবান যদি প্লাষ্টিকের জিনিস না দুনিয়ায না দিত-তাহলে কি আর আমারগুলার পাইল্যা-পাতিল ব্যবসার এই হাল হইত! সে সাথে তিনি আরো বলেন- প্লাষ্টিকের জিনিস আসার পর থেইকা মাটির বড় বড় পাইল্যা-পাতিল,গামলা,কলস আর কেউ নিতে চায়না। আর ছোট ছোট খেলনা পাতি বিক্রি কইরা যা লাভ হয় তা দিয়া ছয় জন মানুষের সংসার চলা তো দুরেই থাক,কিস্তির টাকাই হয়না! তাই কুমারগীরি ছাইড়া পোলার বাপে এখন কৃষি কাজ করে। আর আমরা মহিলা মানুষ বাড়িতে বইয়া বইয়া যেইডা পারি হেইডা দিয়াই বাপ-দাদার এ পেশাটি ধইরা রাখছি।
রত্না রানীর সংসারের মত একই অবস্থা তার পাড়ার অবশিষ্ঠ এগারোটি পরিবারের। তাই তার কথায় সম্মতি জানায়-নিশিবালা, মিলন বালা, মহাদেব পাল, সুদেব পাল, পবন পাল, উৎপল পাল ও জয়দেব পাল।

নাগেশ্বরীর ভিতরবন্দ কুমার পাড়ার জোতিন্দ্র চন্দ্র পাল, শুনিল কুমার পাল, মন্তোষ কুমার পাল বলেন- তাদের পূর্বপূরুষেরা এ কাজ করে খুউব ভাল ভাবে সংসার চালাতো। তাদের কাছ থেকে এ কাজ শিখে তারাও এ কাজটি করে যাচ্ছেন। কিন্তু এটা দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে ব্যবসা চালা তো দুরের কথা সংসার চালাই কঠিন। তাই বাপ-দাদার এ পেশাটিকে টিকিয়ে রেখে সংসার চালাতে প্রতি বছর বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋন নিতে হয় তাদের। একই পাড়ার দুলাল পাল বলেন- কষ্ট করে তৈরী করা বাহারী রঙের ফুলদানি,ফুলের টব,কলস প্লেট, হাড়ি, ঘটি, সরা, পাট, খুঁটি, দিয়ার পাটনা, ধুপতি, বাসনা, পিঠা বানানোর সাজ, মুড়ি ভাজার পাতিল, মাটির ব্যাংক, ছোটদের খেলনা যেমন হাতি, ঘোড়া মন্ত্রি ইত্যাদি জিনিসপত্র তৈরী করে পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করেন তারা। কিন্তু আগের মত বিক্রয় ও সঠিক দাম না পাওয়ায় সংসার চালাতে তাদের অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সে সাথে তিনি বলেন- অনেকেই আবার এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে দিনদিন। তাদের মতে এভাবেই খেয়ে না খেয়ে দিনাপাতি করে এ পেশাটিকে ধরে রেখেছে এ পাড়ার আরো আটটি পরিবার। তবে তারা স্বপ্ন দেখে- ব্যবসার এ মন্দাভাব কেটে ঘুরে দাঁড়াবে একদিন, যুগ-যুগ বেঁচে থাকবে তাদের বাপ্-দাদার এ পেশাটি,সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে তাদের অভাবি সংসার!

এমতাবস্তায়- তাদের স্বপ্ন পূরণে “গ্রাম বাংলার এতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পসহ এ শিল্পের কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিক প্রশিক্ষনের মাধ্যমে মৃৎশিল্পের যুগোপযোগী জিনিসপত্র তৈরী ও দেশ-বিদেশে মাটির তৈরী পণ্যের চাহিদা সৃষ্টির লক্ষ্যে নতুন-নতুন বাজার সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন”। তাই মৃৎশিল্পের এ সংকট মুহুর্তে সকল প্রকার সংকট উত্তরণে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, এমন প্রত্যাশা সকলের!

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads