বাম্পার ফলনও কখনো কখনো হয়ে দাঁড়ায় বিপদের কারণ। এই যেমন টমেটো। কয়েক বছর ধরে এ সবজিটির প্রচুর ফলন হচ্ছে দেশে। কিন্তু কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। কারণ মৌসুমের একপর্যায়ে বাজারে এর সরবরাহ এত বেড়ে যায় যে, দাম নেমে যায় ২ টাকা কেজিতে! এবারও এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। এ অবস্থায় কয়েক বছর ধরেই ক্ষেতে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে টমেটো। কারণ পরিবহন খরচই ওঠে না। ফলে কৃষকও টমেটো তোলেন না। কোথাও কোথাও আবার গরুরও খাদ্য হচ্ছে সবজিটি। এরপরও যে টমেটো বাজারে সরবরাহ করা হয় তার একটি বড় অংশই দিনশেষে অলি-গলিতে পচে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যদিও ভোক্তা পর্যায়ে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। কৃষক পর্যায়ে দাম যতই নামুক, ভোক্তারা কিন্তু ১০ টাকার নিচে টমেটো কিনতে পারেননি। ভরা মৌসুমে এর দাম ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে। অথচ দেশে জুলাই-আগস্ট মাসে টমেটোর সরবরাহ না থাকায় ভারত থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। সে সময় দাম গুনতে হয় কেজিতে ১০০ টাকার ওপরে।
দেশে প্রতিবছর ৭৫ হাজার একর জমিতে প্রায় সাড়ে চার লাখ টন টমেটো উৎপাদন হয়। ভোক্তা পর্যায়ে এর গড় দাম কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে উৎপাদিত টমেটোর দাম ৮০০ কোটি টাকা। সনাতন চাষপদ্ধতি, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের অভাব, সরবরাহ দুর্বলতা, বাজার ব্যবস্থাপনা ও ক্রেতা-বিক্রেতার সচেতনতার অভাবে নষ্ট হচ্ছে এর অর্ধেকটাই। যার বাজারমূল্য ৪০০ কোটি টাকা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে উৎপাদিত টমেটোর ৪৬ শতাংশই সংগ্রহ-পরবর্তী লোকসান (পোস্ট-হারভেস্ট লস) হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ফল ও সবজি ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সংগ্রহ-পরবর্তী লোকসান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ এলাকায় উৎপাদিত সবজি ও ফলের অপচয়ের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দেশভিত্তিক আলাদা পণ্য ধরে তৈরি ওই প্রতিবেদনের সমীক্ষায় বাংলাদেশের টমেটোর প্রসঙ্গ এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টমেটো আবাদের সময় কৃষকরা বাছবিচারহীনভাবে রোগ সংক্রমণ ও কীটপতঙ্গের প্রকোপের আশঙ্কায় ২৯ ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করেন। অনেক ক্ষেত্রে ভালো দামের আশায় অপরিপক্ব টমেটো পাকানোর জন্য বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারসহ ভুল কিছু সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার হয়।
এফএওর প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের টমেটো উৎপাদনের অন্যতম এলাকা বগুড়া থেকে। ওই এলাকার কৃষকরা ক্ষেত থেকে টমেটো তুলে সঠিক উপায়ে সরবরাহ করেন না স্থানীয় বাজারে। আবার তারা রোগাক্রান্ত টমেটো সঠিকভাবে বাছাইও করেন না। বাজারজাতকরণে প্লাস্টিকের ঝুড়ির বদলে ৫০ কেজির বস্তা ব্যবহার করা হয়, যা পরে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অঞ্চলিক পাইকারি মোকামে পৌঁছায়। উভয় ক্ষেত্রেই ঝুঁকিমুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয় না। ফলে প্রাকৃতিকভাবে পচনশীল এই সবজি দ্রুত নষ্ট হতে থাকে। জরিপে দেখা গেছে উৎপাদিত টমেটোর ১৬ দশমিক ৭ শতাংশই স্থানীয় মোকাম পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক এসব মোকাম থেকে সন্ধ্যায় গাজীপুর অথবা ঢাকায় টমেটো পাঠানো হয় অন্যান্য সবজির সঙ্গে গাদাগাদি করে, যা বগুড়া থেকে ১৭৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ সময়টায় সবজির প্রায় অর্ধেকটাই পেকে যায়। বেশিরভাগ পাকা টমেটো এ পর্যায়ে কুঁচকে অথবা ফেটে যায়। শহরের পাইকারি বাজারে এসে পৌঁছানোর আগেই ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ বিক্রির অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
কেন এমন হয় জানতে চাইলে বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক প্রতুল চন্দ্র জানান, বগুড়া জেলায় প্রায় সাড়ে ৪০০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগ জমিতে থাকে মিন্টু জাতের হাইব্রিড টমেটো। ফলে ভরা মৌসুমে বাজারে এর সরবরাহ বেড়ে যায়। এতে প্রতিবছরই এ সময়টাতে দাম পড়ে যায়। আর দাম না থাকায় পাইকাররা টমেটো নিতে অনীহা দেখান।
তিনি মনে করেন, কৃষক যাতে টমেটোর দাম পায় তার জন্য মার্কেট লিংকেজ বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে সবজিটি চাষ করা প্রয়োজন। তবে এ পর্যন্ত এমন কোনো সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এফএও আরো বলছে, সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় প্রতি কেজি টমেটোর দাম সর্বোচ্চ ৫ টাকা পান কৃষক। আর পাইকারি পর্যায়ে এসে এর দাম হয় ১০ ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কিন্তু অসময়ে বাংলাদেশে আমদানি করা টমেটো এর কয়েক গুণ দামে বিক্রি হয়।
এফএও’র সমীক্ষা এও বলছে, সাধারণ কয়েকটি ভুল পদ্ধতির কারণে বাংলাদেশে এ সবজিটি বিপুল পরিমাণে নষ্ট হচ্ছে। শুধু টমেটো সংগ্রহের সময় সময় কাঁচি ব্যবহার করে বোঁটাসহ তা সংগ্রহ, সঠিকভাবে আক্রান্ত সবজি আলাদা করা ও ক্লোরিন পানিতে ধুয়ে ব্যাকটেরিয়া রোধ এবং প্লাস্টিকের ঝুড়িতে পরিবহন করা গেলে অপচয় ২ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) সাবেক মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল জানান, উৎপাদিত টমেটোর অর্ধেক নষ্ট হচ্ছে। তবে ফসল-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সঠিক ব্যবস্থাপনা আর সামান্য সচেতনতায় এ লোকসান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ জরুরি।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আমাদের বগুড়া প্রতিনিধি আমজাদ হোসেন মিন্টু।