সুজন বর্মণ, নরসিংদী:
গ্রীষ্মের দাবদাহে অতিষ্ঠ প্রাণ, খুঁজে ফিরে একটু স্বস্তির পরশ। সেই অবস্থায় বাঙ্গি প্রাণে এনে দেয় শান্তি, দূর করে শরীরের ক্লান্তি। বাঙ্গি অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি ফল। সেই হিসেবে দেশের সর্বত্রই এ ফলটির চাহিদা রয়েছে। গ্রীষ্মের অন্যতম ফল বাঙ্গি চাষে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠছে নরসিংদীর চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের বাঙ্গি আকারে বড়, দেখতে সুন্দর ও স্বাদে অনন্য হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে। অল্প শ্রম ও খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় প্রতি বছরই নরসিংদীর চরাঞ্চলে বাড়ছে বাঙ্গির আবাদ। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মৌসুমী কর্মসংস্থানেরও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ চরাঞ্চলেই বাঙ্গি উৎপন্ন হয়। পলি, পলি দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ— এসব মাটি বাঙ্গি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বাঙ্গি আকারে বেশ বড় হয়। কাঁচা ফল সবুজ, পাকলে হলুদ রঙের হয়। একটু বেশি পেকে গেলে বাঙ্গি সহজে ফেটে যায়। ফলের বাইরের দিকটা মিষ্টি কুমড়ার মতো হালকা ডোরাকাটা খাঁজযুক্ত। এর ভেতরটা ফাঁপা থাকে। খেতে তেমন মিষ্টি নয়।
জেলায় এ বছর ৭৪ হেক্টর জমিতে বাঙ্গির আবাদ হয়েছে । এর মধ্যে রায়পুরা উপজেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে বাঙ্গি। যার মধ্যে বাঁশগাড়িতে ২০ হেক্টর ও বাকি ১৫ হেক্টর পাড়াতলীর মধ্যনগর, চাঁনপুর ও মির্জাচরে আবাদ হয়েছে।
মেঘনা নদীর তীরঘেঁষে রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ি ও পাড়াতলী ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল চর। বিস্তীর্ণ চরের ধান ও মসলা জাতীয় ফসলের পাশাপাশি বাঙ্গি চাষ করা হয়েছে। মাটির ওপর ছড়িয়ে রয়েছে বাঙ্গিগাছের সবুজ লতা। লতার ফাঁকে ফাঁকে কাঁচা—পাকা বাঙ্গি শোভা পাচ্ছে।
কৃষকরা জানায়, বাঙ্গি চাষ করতে তেমন খরচ লাগে না। রসুন ও বাঙ্গি দুই ফসল একবারে চাষ করেন। প্রথমে রসুন তুলে নেয়ার পর বাঙ্গি বিক্রি শুরু হয়। ভাল লাভ পাওয়ায় প্রতিবছর বাড়ছে বাঙ্গির আবাদ।
বাঁশগাড়ি গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, আগে মরিচ চাষ করতাম। এখন ৮ থেকে ১০ বছর ধরে বাঙ্গি চাষ করি। প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার বাঙ্গি বিক্রি করি। দাম ভালো পাওয়া আমরা বাঙ্গি চাষ করে লাভবান হচ্ছি। যারফলে পরিবার নিয়ে সুন্দর ভাবে চলতে পারছি।
আরেক কৃষক ফজলু মিয়া বলেন, আমাদের বাঙ্গি বেঁলে জাতের বাঙ্গি। এটি খেতে খুব সুস্বাধু হয়। দেশের অন্য কোন স্থানে এই বাঙ্গি পাওয়া যায় না। যার কারণে দূরদূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে ক্ষেত থেকেই বাঙ্গি কিনে নিয়ে যায়।
কৃষক মোঃ ইসমাইল বলেন, এবার ৮০ শতাংশ জমিতে বাঙ্গি চাষ করেছি। এতে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করি জমি থেকে তিন লাখ টাকার বাঙ্গি বিক্রি করতে পারবো।
জমি থেকেই বাঙ্গি কিনতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ক্রেতারা কৃষকদের সঙ্গে দরদাম করছেন। দুই পক্ষের যুক্তিতর্কে চলেছে বেচাকেনা। জমি থেকে প্রতিপিছ বাঙ্গি পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। পরে পাইকারদের মাধ্যমে সুস্বাদু এ ফলটি পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। খুচরা পর্যায়ে যা বিক্রি হয়ে দেড়শ থেকে দুইশ টাকায়।
ঢাকা থেকে বাঙ্গি কিনতে এসেছেন পাইকারী ফল ব্যবসায়ী আকবর হোসেন। তিনি বলেন, রায়পুরার চরের বাঙ্গির বাজারে অনেক চাহিদা রয়েছে। এটি সুস্বাদু ও আকারে বড় হওয়ায় ক্রেতারা পছন্দ করে বেশি। যার ফলে কম সময়ে অধিক পরিমাণে বিক্রি করা যায়। এবার আমি ২৫০ পিছ বাঙ্গি কিনেছি ৫ হাজার টাকা শতক ধরে।
কাওরান বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ী নাদিম হোসেন বলেন, বাঙ্গির আকার ভেদে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। প্রতিদিনই আমরা ৫০০ থেকে ৭০০ বাঙ্গি কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যাই। তবে চরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে আমাদের বাঙ্গি পরিবহনে খুব কষ্ট করতে হয়। আমাদের পরিহবহন খরচ ও বেড়ে যায়। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হলে আমরা আরো বেশি পরিমাণে বাঙ্গি কিনতে পারতাম।
মাঠ থেকে তোলা বাঙ্গি সড়কপথে ও নৌ পথে নেয়া হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। জমি থেকে প্রতিপিছ বাঙ্গি পাইকারদের গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে মৌসুমী শ্রমিকরা পান ৭ থেকে ১০ টাকা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থানেরও। তবে চরের রাস্তাটি কাঁচা হওয়ায় বাঙ্গি পরিবহনে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
মৌসুমী শ্রমিক হাফিজ মিয়া বলেন, আমরা ক্ষেত থেকে ঝুড়িঁর মাধ্যমে বাঙ্গি পাইকারদের ট্রাক বা নৌকায় তোলে থাকি। এইভাবে আমরা প্রতিদিন আটশত থেকে হাজার টাকা আয় করে থাকি। তবে রাস্তায় খানাখন্দ থাকায় আমাদের বেশি কষ্ট করতে হয়। রাস্তা ভালো থাকলে আমাদের আয় আরো বেড়ে যেতো।
আরেক শ্রমিক হাসান মিয়া বলেন, মার্চ — এপ্রিল মাসে আমরা বাঙ্গি পাইকারদের ট্রাক বা নৌকায় তোলার কাজ করি। প্রায় অর্ধ শতাধিক শ্রমিক এ কাজ করে তাদের সংসার চালাচ্ছে। রাস্তা খারাপ থাকায় আমাদের মাঝে মধ্যে দূর্ঘটনায় পড়তে হয়। রাস্তা গুলো মেরামত করা হলে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হতো।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ—পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, অল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে বাঙ্গির আবাদ। এবার জেলায় বাঙ্গির বাম্পার ফলন হয়েছে। যা থেকে উৎপাদন হবে প্রায় এক হাজার টন বাঙ্গি। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। বাঙ্গি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হওয়ায় দিনদিন এর চাহিদা বাড়ছে। আগামীতে বাঙ্গির আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করছে। কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগীতার মাধ্যমে বাঙ্গির ফলন আরো বৃদ্ধি করা হবে।