ঝড়-তুফানের মতো প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে চরের অভাবী মানুষ যেখানে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য করছে— সেখানে সমাজের রক্তচক্ষু, তিরস্কার, কুসংস্কার, বাল্যবিয়ের মতো খড়গকে মাড়িয়ে চন্দ্রদ্বীপের কন্যারা এগিয়ে চলেছে উচ্চশিক্ষার আশায়। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে রাজকুমার যেমন রাজকন্যার সন্ধানে ছুটে চলে, তেমনিভাবে খাল, নদী, বিল পেরিয়ে শিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন বুকে প্রতিদিন দুর্গম পথে পাড়ি জমায় চন্দ্রদ্বীপের শিক্ষার্থীরা। চর এলাকার সালাম হাওলাদারের মেয়ে শাহনাজ। পড়াশোনায় যেমন ভালো, তেমনি সাহসী। তবে কলেজে যেতে তাকে প্রতিদিন নৌকায় পাড়ি দিতে হয় প্রায় দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত উত্তাল তেঁতুলিয়া নদী। বুকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন লালন করে বাউফলের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চন্দ্র্রদ্বীপ ইউপির চর মিয়াজানের শাহনাজের মতো নৌকায় পথ পাড়ি দিতে হয় একই চর ও পাশের আলগীরচর, রায়সাহেব ও চরনিমদী থেকে ধানদী ফাজিল মাদরাসার শতাধিক শিক্ষার্থীকে।
নৌকায় কথা হয় শাহনাজের সঙ্গী ধানদী ফাজিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী চর মিয়াজানের সুমীর সঙ্গে। সুমী জানায়, খেয়ার নৌকায় এত বড় নদী পাড়ি দিয়ে ক্লাস ধরতে প্রায়ই দেরি হয়। ক্লাস কামাই দিতে হয় ঝড়-তুফান কিংবা জোয়ারের পানিতে নিচু এলাকা তলিয়ে গেলে। অল্প-স্বল্প পানিতে চর তলিয়ে গেলে বাড়ি থেকে খেয়াঘাট আসতে প্রয়োজন হয় আরো একটি নৌকার। এ ছাড়া শীতে কুয়াশায় ঢাকা পড়লে খেয়ায় পাড়ি দিয়ে প্রায়ই সময়মতো মাদরাসায় পৌঁছানো যায় না। মেয়েদের জন্য চরের নির্জন পথ তখন হয়ে ওঠে বিপদসঙ্কুল।
কিছুদিন আগে খেয়ার নৌকা উল্টে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নার্গিস। সেদিন নদীতে বই-খাতা ভেসে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে নার্গিস বলে, ‘স্কুলে যাইতে এত কষ্টে নদী পার অই। হ্যার পর খেওয়া ভাড়াও লাগে মাসে ১০০ টাহা। আমাগো চরের ছাত্রছাত্রীগো স্কুল-মাদরাসায় পরীক্ষার ফি, বেতন ও অন্যসব টাহা-পয়সা কমাইয়া লওয়া উচিত।’ এ সময় নার্গিসের সঙ্গে থাকা এসব দুর্গম চরের শতাধিক শিক্ষার্থী দাবি জানায় উত্তর চন্দ্রদ্বীপে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার।
অপরদিকে চন্দ্রদ্বীপের চরওয়াডেলের খেয়ায় পার হওয়া কালাইয়া ইদ্রিস মোল্লা ডিগ্রি কলেজ ও বাউফল সরকারি কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, মূল ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন রায়সাহেবচর, চরমিয়াজান, চরকচুয়া ও চরআলগীসহ ১০টি চর নিয়ে নবগঠিত চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নে ১৯৯৫ সালে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু দুর্গম হওয়ায় রায়সাহেবচর, চরমিয়াজান, চরনিমদী, পাঁচখাজুরিয়া, কিসমত পাঁচখাজুরিয়া ও চরআলগীর শিক্ষার্থীদের ওই হাইস্কুলে কোনোমতেই পৌঁছা সম্ভব হয় না। যে কারণে তারা অবহেলিত এসব চরের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে উত্তর চন্দ্রদ্বীপের চরমিয়াজানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
এ বিষয়ে চরের মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করা ‘স্লোভ বাংলাদেশ’ নামে স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাউফলের চরাঞ্চলের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থা কাজ করছে না। গণশিক্ষার অধীনে শ্রাবণ নামে এক উন্নয়ন সংস্থা এ সম্পর্কিত প্রকল্প হাতে নিলেও কবে নাগাদ তার কার্যক্রম চালু হবে তা বলা যাচ্ছে না। উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দুর্গম চন্দ্রদ্বীপের প্রাইমারি স্কুলেও শিক্ষকরা যেতে চান না। মাঝেমধ্যে পিয়ন দিয়ে ক্লাস পরিচালনার কথাও শোনা যায়। এমন বাস্তবতায় যথাযথ শিক্ষার সুযোগ না পেলে চরের ছেলেমেয়েরা আরো পিছিয়ে পড়বে।’
এ বিষয়ে চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক আলকাস মোল্লা বলেন, ‘আ. স. ম. ফিরোজ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের মেয়েদের এখন আর প্রাইমারি স্কুল শেষে লেখাপড়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয় না। এসএসসি দিতে পারে। তবে দুর্গম-দূরত্ব বিবেচনায় চন্দ্রদ্বীপের মিয়াজান-রায় সাহেবেরচর এলাকায় একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা খুবই জরুির। একই সঙ্গে কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে চরের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হবে। তাই সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অনুরোধ জানাচ্ছি।’