মো. নজরুল ইসলাম নোবু
বর্তমান সময়ে ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। পত্র-পত্রিকা খুললে এমন কোনোদিন নেই যে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর দৃষ্টিগোচর হয় না। দুর্ভাগ্যবশত, সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন আরো বিপজ্জনক হারে বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন। একক ধর্ষণের শিকার ৭৬২ আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২০৮ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। আর ১৬১ জন নারী হয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন নারী ও ৯ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। এই সময়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ জন নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার ২৭৯ আর পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ জন নারী। ১ হাজার ৭৮টি শিশু শারীরিক নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকার হয়েছে। নিহত হয়েছে ৪৪৫টি শিশু, ধর্ষণের শিকার ৬২৭ শিশু।
অন্য আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৪০০ জন নারী এবং ৮১৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৯০ জন নারী এবং ৭২৭ শিশু। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছসরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করে, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে।’ ২০০৩ সালের সংশোধননীতে বয়সসীমা কমিয় ১৬ থেকে ১৪ বছর করা হয়েছে।
ধর্ষণ বর্তমান সমাজে নারীদের স্বাভাবিক চলাচল ও বিকাশের পথে একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, যে কোনো সময়ে একজন নারী হারাতে পারে তার সম্ভ্রম। হতে পারে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। সত্যি বলতে নারী ও শিশুদের জন্য এ সমাজ এখন অনেকাংশে অরক্ষিত। এজন্য মূলত পুরুষের বিকৃত মানসিকতা এবং দেশে বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার চরম নাজুকতাই দায়ী। সমাজ থেকে যখন ন্যায়নীতি ও মানবিক মূল্যবোধ বিদায় নেয়, তখন সমাজে বিভিন্ন অপরাধপ্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। অপরাধ দমাতে তখনি প্রয়োজন হয় আইন ও বিচারিক হস্তক্ষেপ। কিন্তু সেই আইন বা বিচারিক প্রক্রিয়া যদি ত্রুটিযুক্ত হয় অর্থাৎ আইনের শাসন না থাকে তখনি অপরাধগুলো বৃদ্ধি পায়। ফল হিসেবে বৃদ্ধি পায় দুর্নীতি, চোরাকারবারি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি।
একটি দেশে আইনের শাসন অতীব জরুরি। আইনের শাসন ব্যতিরেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুশাসনের অন্যতম দাবি হলো— একটি স্বচ্ছ আইনি কাঠামো থাকবে এবং এটি প্রতিটি মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ‘আইনের চোখে সবাই সমান’— এটি হবে সুশাসনের ভিত্তি। আইনের শাসনের উপস্থিতি ব্যতীত সুশাসন কায়েম হয় না। আইনের শাসনের অর্থ হলো আইনের প্রাধান্য স্বীকার করা এবং আইন মোতাবেক শাসন করা। আইনের শাসন যেখানে বর্তমান সেখানে জনগণের স্বাধীনতা বিরাজমান। আইনের শাসনের দ্বারা সাম্য, স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এসব কারণেই আইনের শাসন সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি মানুষের মাঝে ধর্ষণ ছাড়াও অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা বাড়ার পেছনে বিচারহীনতা, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, জবাবদিহিতার স্বল্পতা, পেশাদারিত্বের অভাব, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি কারণও দায়ী।
এখন চারদিকে ধর্ষণকাণ্ড দেখে যে কেউ বলবেন, দেশ থেকে আইনের শাসন উধাও হয়ে গেছে। বাস্তবিকই তাই। আত্মমত্ত প্রশাসনের কাছে ন্যায়বিচার, সুশাসন, মৌলিক অধিকার— এসব আজ দূর মরীচিকা। দেশে আইন আছে, আইনের বাস্তবায়ন নেই। প্রতি বছর হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। হাতেগোনা কয়েকটি ধর্ষণের বিচার হয়েছে। বাকি আসামিদের কেউ জামিনে মুক্তি পেয়েছে, আর অধিকাংশরই বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে আটকে আছে বিচারকার্য। অনেক সময় দেখা যায়, গ্রামীণ বা স্থানীয় পর্যায়ে সালিশে সামান্য জরিমানা দিয়েই ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়। যত দিন না ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন এর লাগাম টেনে ধরাও সম্ভব নয়। এছাড়া বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা, সামাজিক সচেতনতার অভাব, যৌন শিক্ষার অভাব, ধর্মীয় অনুশাসন না মানা ইত্যাদি ধর্ষণের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয়। তাই নারীদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, এভাবে নিজেদের সহজলভ্য করবেন না। যাকে তাকে বিশ্বাস করা অপরিপক্বতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিশেষে বলব, বাংলাদেশে এক সময় এসিড নিক্ষেপ একটি ভয়াবহ সমস্যা ছিল। কিন্তু ব্যাপক প্রচারণা ও মৃত্যুদণ্ড বিধানের পর এসিড নিক্ষেপ আজ বহুলাংশে কমে গেছে। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের ধর্ষণ বিষয়েও তদ্রূপ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রমাণিত ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বিচারিক প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে হবে। ভিনদেশিদের অপসংস্কৃতি পরিহার করে দেশীয় সুস্থ সংস্কৃতি বিস্তার ঘটাতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। সর্বোপরি ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই এ সমাজ আবালবৃদ্ধবনিতা তথা আপামর জনতার হয়ে উঠবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক
kmnajrulislam64@gmail.com