ধর্ষক, ধর্ষণ ও আমাদের নেতৃত্ব

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

ধর্ষক, ধর্ষণ ও আমাদের নেতৃত্ব

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ৬ অক্টোবর, ২০২০

দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মার্চের ১৭ তারিখ থেকে বন্ধ। কলেজ হোস্টেলে কীভাবে ছাত্ররা থাকে? থাকে কারণ তারা ছাত্র নয়, ক্যাডার। ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটছে যা ঘটত সেই ১৯৭১ সালে। ভিনদেশি ধর্ষকরা শত্রুপক্ষের নারীদের যা ইচ্ছে তা করা যায় ভেবে তাই করত। কিন্তু স্বাধীন দেশে কারা ধর্ষণ করে? যারা জানে যে, তাদের ভিন্ন একটি পরিচয় আছে, যারা জানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না, যারা জানে জনমতের চাপে আপাত ধরা পড়লেও কেউ তাদের বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে না। তারাই তো ধর্ষণ করে মেয়েকে মা-বাবার সামনে, স্ত্রীকে স্বামীর সামনে, প্রেমিকাকে প্রেমিকের সামনে, ছাত্রীকে শিক্ষকের সামনে। সভ্যতার মুখোশের আড়ালে কত অসহায় মেয়ে সমাজকে ধিক্কার দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে তার হিসেব এই সমাজ রাখতে চায় না।  প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমাজ আমরা কেন সৃষ্টি হতে দিলাম? কেন আমরা পারি না যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা যতই থাকুক কেউ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করার কোনো সাহসই পাবে না? জনগণের সম্পদ, জনগণের জমানো টাকা বিদেশে পাচার করা যাবে না? সে ধরনের সমাজ সৃষ্টি করা কি খুব কষ্টকর? সেটি করলে কি কারো কোনো ক্ষতি হয় বা হতো? বরং লাভই হয়। কিন্তু ঘটনা ঘটার পরে আমরা বিভিন্ন ধরনের বিবৃতি দেখি- ‘কেউ রেহাই পাবে না, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’ ইত্যাদি। কিন্তু যা ঘটে গেছে তার তো প্রতিকার নেই, অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা যে সারাজীবন কুরে কুরে একজন ভুক্তভোগীকে খায় তার কি কোনো বিনিময় আছে? তাহলে এই জঘন্য অপরাধ যাতে ক্ষমতাসীনরা না করতে পারে সেই ব্যবস্থা কি আমরা করতে পারি না?

যুদ্ধ হচ্ছে অমানবিকতার প্রকাশ, দানবের প্রতিকৃতি। তাই যুদ্ধকালীন সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকে। দানবীয় উল্লাসে তখন মানবাকৃতির দানবরা এই অমানবীয় খেলায় মেতে ওঠে আর যুদ্ধবাজ নেতারা ভাবেন এটাও প্রতিশোধের, যুদ্ধ জয়ের এক হাতিয়ার। কিন্তু আমাদের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব দানব কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? কাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে? নিশ্চয়ই মানবতার বিরুদ্ধে। তাহলে তাদের আমরা কেন এত তোয়াজ করি? কেন এত সুবিধা দেই? কি দেয় তারা আমাদের, সমাজকে ও দেশকে? সারা পৃথিবীতে চলছে করোনা মহামারী। অনেকেই এটিকে প্রকৃতির প্রতিশোধ কিংবা মানবজাতিকে শিক্ষা দেওয়ার এক উপায় বলছেন। এটি তো আমরা অস্বীকারও করতে পারি না। চোখের সামনে দেখছি পৃথিবীর সব বড় বড় এবং ক্ষমতাবান রাষ্ট্র কুপোকাত। প্রতিটি দেশেই দেখা যাচ্ছে বহু ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী, ধনী মানুষ দেখতেই না দেখতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। কিন্তু আমাদের যেন হুঁশ হচ্ছে না। আমরা যেন এই মহা পৈশাচিক উল্লাস সারা জীবন চালিয়ে যেতে পারব? আমরা দেদার চালিয়ে যাচ্ছি যা করতাম তার সবই। একজন নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন করার অর্থ তার দেহ যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষত-বিক্ষত জমিনের সঙ্গে তুলনীয়। সেই বিভীষিকা নিয়ে একজন নারীকে বেঁচে থাকতে হয় এই স্বাধীন দেশে। এ কেমন বর্বরতা? আর যত বড় বড় ধর্ষণের ঘটনা সবই দেখা যায় বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা তথাকথিত সভ্য জায়গায়।

করোনার এই মহামারীর মধ্যে ধর্ষণ থেমে নেই। একটি বিষয় আমরা লক্ষ করেছি যে, জনরোষের চাপেই হোক আর যে কারণেই হোক ধর্ষকের যারাই তারা প্রায় সবাই ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের কেউ নেই। কারণ তারা নিজেদের অস্তিত্বই রক্ষা করতে পারছে না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তারা যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকত তাহলে দেখা যেত, এসব অপকর্মে যারা ধরা পড়ছে, তারা প্রায় সবাই ছাত্রদলের। এখানেই আমাদের প্রমাণ করিয়ে দেয়, ধর্ষণের পেছনে আসলে ক্ষমতাই মূল উৎস। আমরা জাতীয় নেতাদের যে বিবৃতি দেখি, বিএনপির নেতারাও তখন একইভাবে এবং একই সুরে বিবৃতি দিতেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, এই বিবৃতি দিয়ে, এসব কথা বলে ধর্ষণ কি বন্ধ হচ্ছে? উপস্থিত জনতার সামনে দিয়ে বিনা কারণে স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করে, স্বামীকে মারপিট করে হোস্টেলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে অথচ জনতা কোনো কিছু বলতে সাহস পায়নি। কতবড় সস্ত্রাসী আমরা লালন করছি এসব উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এখানে আরো লক্ষণীয়, পুলিশ কিন্তু ঠিকই সন্ত্রাসীদের ধরে ফেলেছে, তার মানে হচ্ছে, তারা পারে যখন দেখি পারে না, তার পেছনে অন্য কারণ আছে। এটিও প্রমাণিত হলো।

পত্রিকায় এসেছে স্থানীয়রা টের পেত যে, অনেক রাত পর্যন্ত এসব সন্ত্রাসীরা হই-হুল্লোড়, জুয়া ও তাস খেলে এবং মদ্যপান করে সময় কাটাত যদিও সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে তারা কিছু বলতে পারত না। আমরা সবাই জানি তারপরও আবারো প্রমাণিত হলো যে, শিক্ষা প্রশাসনে যারা আছেন বিশেষ করে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এদের কিছুই বলতে পারে না। বলতে গেলে তাদের হয় চাকরি হারাতে হবে নয় জীবন হারাতে হবে। এর কোনোটিই তো আমরা হারাতে চাই না, আর এই সুযোগটিই নিয়ে থাকে এসব সন্ত্রাসী। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, বরিশাল বিএম কলেজের অধ্যক্ষকে ছাত্রদলের ক্যাডাররা তার রুমে ঢুকে টেবিলের গ্লাস ভেঙে সেই গ্লাস দিয়ে অধ্যক্ষকে রক্তাক্ত করেছে। রাষ্ট্র সেটিকেই মেনে নিয়েছিল। সেসব ক্যাডাররা আজ কোথায়? লেজগুটিয়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়েছে। এরা সর্বকালেই ক্ষমতার দাপটের আড়ালে এসব অপকর্ম চালিয়ে যায়। এরা শুধু পরিবারের এবং এলাকার নয়— গোটা সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার শত্রু। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এরাই পরম যত্নে লালিত-পালিত হয় রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। এই পুরনো কথাটি দেশের সাধারণ মানুষ সর্বদাই প্রত্যক্ষ করে, কিন্তু এর যেন কোনো প্রতিকার নেই। শুধুই প্রকৃতির প্রতিশোধের অপেক্ষায় থাকতে হয়।

এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অহরহ চলছে গ্রামে, ইউনিয়নে, উপজেলায়, জেলায়, বিভাগে, রাজধানীতে, সমস্ত ধরনের প্রতিষ্ঠানে। কেই এদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধরা পড়ে না, ধরার সাহসও সমাজ পায় না। এ রকম দু-একটি ঘটনা যখনই প্রকাশ পায় তখনই আমরা দেখি রাজনৈতিক দল থেকে বলা হয়, এরা দলের কেউ নয়, দলের নীতিনির্ধারণীতে নেই কিংবা বেশি জনমতের চাপ থাকলে শুনি তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হলো। কিন্তু এরা যাতে এসব অপকর্ম করতে না পারে, সাহস না পায় সেজন্য আমরা কি করছি? এর সদুত্তর থাকলে বোধহয় সমাজে মানুষ অন্তত একরকম বেঁচে থাকতে পারত। এ তো মরে বেঁচে থাকা! কোথাও নিরাপদ নয় নারী। নিরাপদ নয় শিশু, তরুণী, বিবাহিতা, অবিবাহিতা, মধ্যবয়সি এবং বেশি বয়সি। এ সমাজের কি কিছুই করার নেই এসবের বিরুদ্ধে?

রাজনৈতিক প্রশয়ে থাকায় এদের কিছু হয় না, হলেও লঘু কোনো দণ্ড হয়। ফলে এরাই লাভবান হয় আর সমাজ হয় সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত। মানবতা নীরবে কেঁদে মরে। ধর্ষক, সন্ত্রাসী ও লুটেরা এভাবে সমাজে প্রশ্রয় পেয়ে বিশাল মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। তাদের যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি, খাবার ও পানীয় দেওয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে, জনগণের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থ থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার স্বার্থে রাখা অর্থ— এক টাকা, দু-টাকা নয়, এক হাজার, দুই হাজার নয়— হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। তারা এত টাকা দিয়ে করবে? নারী ভোগ আর মদ্যপান ছাড়া আর কিই-বা করার আছে তাদের? আমরা তাদের পরমযত্নে লালন করছি, উঁচু উঁচু স্থানে বসিয়ে দিচ্ছি। সমাজকে আমরা এভাবেই এগুতে দিচ্ছি। তাহলে কি মানবতা, সততা, সৎ মানুষ হওয়ার শিক্ষা আমরা একেবারেই নির্বাসনে পাঠালাম? প্রশ্নটি আজ সমগ্র জাতির।

 

লেখক : শিক্ষ বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

masumbillah65@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads