জাকাতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিবদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে সহায়তা করা। পবিত্র ইসলাম ধর্মে রমজান মাসে সিয়াম বা রোজার সাধনাকে দেহের জাকাতস্বরূপ বলা হয়েছে। ধর্মে বলা হয়েছে, রমজান মাসে যেকোনো ধরনের দান-সদকা অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি নেকির শামিল। রমজান মাসেই জাকাত আদায় করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সাধারণত এ মাসেই সামর্থ্যবান মুসলমানরা গরিবের এই হকটি পূরণ করে থাকেন। রোজা পালনের পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা জাকাত ও ফিতরা দুটি আর্থিক ইবাদত করে আত্মতৃপ্তি তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন। তবে মনে রাখতে হবে, ধনী লোকের জাকাত-ফিতরা বা দান-সদকা গরিব বা পীড়িত লোকের প্রতি কোনোরূপ করুণার বিষয় নয়; বরং আল্লাহ নির্দেশিত বান্দার হক। আরো সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে, জাকাত গরিবের প্রতি ধনীর অনুগ্রহ নয়, বরং ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার। জাকাত ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম উপাদান। তবে একটা কাপড় পেলে নিশ্চয়ই কোনো গরিব অভাব-অনটন থেকে মুক্ত হতে পারে না। ফলে মূল উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ রেখেই জাকাত আদায় করতে হবে। দেশের বিত্তশালী লোকেরা যদি তাদের সম্পদের হিসাব করে যথাযথভাবে জাকাত আদায় করেন, তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটন অনেকাংশেই দূর হবে। সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে পবিত্র ইসলাম ধর্মে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এক গবেষণা থেকে জানা যায়, শতকরা ৮৫ ভাগ মুসলমানের দেশে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু হলে পাঁচ বছরে দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলা হয়েছে— দেশে পাঁচ লাখ পরিবার রয়েছে, যাদের নিজস্ব সম্পদ বলে কিছু নেই। আবার ২৭ লাখ পরিবার রয়েছে, যাদের মালিকানায় সম্পদের পরিমাণ এক একরের কম। অপরদিকে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে ৯৫ শতাংশ সম্পদ। দেশের মোট জমির ৮০ ভাগ এই শ্রেণির দখলে! আমরা জানি, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশে প্রায় ১৫০০ বছর আগে জাকাতের অর্থ দিয়ে জনগণের মধ্যে পানি সরবরাহের পাম্প স্থাপন করেছিলেন, যার সুবিধা এখনো ভোগ করছে মানুষ।
ইসলামী পরিভাষায় ধনীদের ধনসম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত আবশ্যিক দেয় অংশকে জাকাত বলে। জাকাত একদিকে জাকাতদাতার ধনসম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে, অন্যদিকে দরিদ্রদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অথচ আমাদের দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত বোর্ডের ভূমিকা খুব একটা লক্ষ করা যায় না। জাকাত বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতেও তাদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। আমরা দেখছি— এনবিআর ধনীদের কাছ থেকে কর আদায়ে বহুমুখী কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। কর প্রদানে রাষ্ট্রের উন্নয়নে সচেতনতা সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। জাকাত বোর্ড ও ইসলামী ফাউন্ডেশন কর আদায়ের মতো জাকাত আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে। জাকাত আদায়ের লক্ষ্যে সক্ষম ধনীদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে বিভাগ, জেলা ও থানাভিত্তিক জাকাত আদায় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তবে জাকাত নিয়ে যেন আবার জালিয়াতি না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
চীনের এক শীর্ষ ধনী তার সব সম্পত্তি একটি দাতব্য সংস্থাকে দান করে দিয়েছেন, যার মূল্য ১২০ কোটি ডলার। জানা গেছে, সমাজকল্যাণমূলক কাজে ৮৮ বছর বয়স্ক ইউ পেংনিয়ানের বিশাল অঙ্ক দানের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। পরপর পাঁচ বছর তিনি চীনের দাতাদের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছেন। উদারভাবে দান করার মতো মহানুভবতার কারণে তাকে আমেরিকার খ্যাতনামা দানবীর অ্যান্ডরু কার্নেগির অনুকরণে ‘চীনের কার্নেগি’ হিসেবে সম্মান করা হয়। পেংনিয়ান বলেছেন— এটাই আমার শেষ দান। কারণ দান করার মতো আমার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই! তিনি আরো বলেছেন, সন্তানদের জন্য আমার অর্জিত সম্পদ রেখে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। তারা যদি অযোগ্য হয়, তাহলে রেখে যাওয়া বিশাল অঙ্কের অর্থ কেবল তাদের ক্ষতিই করবে। কী অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি! আমাদের পুঁজিবাদী সমাজ কি এমন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করবে?
অনুসন্ধানে যতদূর জানা গেছে, ইসলামী দেশসমূহে জাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে জাকাত আদায়ের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম) এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে ২৫ হাজার কোটি টাকা জাকাত আদায় করে তা বণ্টন করা সম্ভব। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে জাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা। এর আড়াই শতাংশ হারে জাকাতের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। সঠিকভাবে জাকাত আদায় করলে ১৫ বছরে দেশে জাকাত নেওয়ার মতো কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। জাকাত আদায়ের কয়েকটি খাত উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ফসলি জমির মালিক এক হাজার কোটি, গচ্ছিত স্বর্ণ অলঙ্কারে একশ’ কোটি, ব্যাংকিং খাতে ১ হাজার ২৪০ কোটি, শিল্প কারখানা থেকে এক হাজার কোটি, সঞ্চয়পত্র ও বন্ড থেকে বছরে তিন হাজার কোটি টাকা জাকাত আদায় করা সম্ভব। ‘মেকিং এ ডিফারেন্স উইথ জাকাত’ প্রতিপাদ্যে চতুর্থ জাকাত মেলার অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বর্তমানে দেশে ১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ কোটিপতি রয়েছেন; যদিও এটা সঠিক হিসাব নয়। অনেকে বলে থাকেন, দেশে ১০০ জন হাজার কোটি টাকার মালিক। এরা সবাই সঠিকভাবে জাকাত দিলে গরিব লোক থাকবে না। এর বাস্তব প্রমাণও আছে। হজরত উমর (রা.)-এর সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনের কারণে ইয়েমেন প্রদেশে জাকাত গ্রহণের মতো লোক পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। একইভাবে উমর বিন আবদুল আজিজের শাসনামলে মিসরেও জাকাত গ্রহণের মতো অভাবী লোকের সংখ্যা খুবই কম ছিল। সৌদি আরব, ইয়েমেন, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম দেশে এখনো সরকারি ব্যবস্থাপনায় জাকাত আদায় ও বণ্টন করা হয়। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও এ দেশে জাকাত আদায়-বণ্টন সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক নয়।
আমাদের দেশের বিত্তবান বেশিরভাগ মুসলমান ব্যক্তিপর্যায়ে জাকাত প্রদান করেন। তাদের অনেকে জাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র-অভাবী আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে সাহায্য করেন। কেউ কেউ জাকাত হিসেবে শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে থাকেন। অনেকে জাকাতের অর্থ দিয়ে মাদরাসা, এতিমখানা কিংবা লিল্লাহ বোর্ডিং পরিচালনা করেন। ধনী লোকের জাকাত দেওয়া বাধ্যতামূলক। জাকাতে সম্পদের পরিশুদ্ধতা আসে, মানব জীবনাচরণে আত্মসংমের সৃষ্টি হয়। জাকাত দিতে হবে হিসাব মতো, বুঝে-শুনে। মনে রাখতে হবে জাকাত প্রদানের উদ্দেশ্য অভাবগ্রস্তের অভাব দূরীকরণ। জাকাত কখনই রিলিফের মতো ব্যানার প্রদর্শন করে, মাইকিং করে দেওয়াও ঠিক নয়। জাকাত দেওয়া উচিত সম্মানের সঙ্গে কারণ এটা জাকাত প্রার্থীর অধিকার আর জাকাত প্রদানকারীর কর্তব্য- যা মহান আল্লাহর নির্দেশনা।
তাই ভাবনার বিষয়টি হলো— শাড়ি-লুঙ্গির চেয়ে দরিদ্রদের সাংসারিক অনটন ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে উপযুক্ত হারে নগদ অর্থ দ্বারা জাকাত আদায় করলে তারা সত্যিকারভাবে উপকৃত হবে। কারণ, জাকাতের উদ্দেশ্য সাময়িক সমাধান নয়— স্থায়ীভাবে অভাবমোচনের উপায় করে দেওয়া। সমাজের সামর্থ্যবান মানুষেরা যদি নিজ নিজ গ্রামের গরিব এবং দুস্থ আত্মীয়স্বজনকে দোকানপাট, নৌকা, ট্রলার, ভ্যানগাড়ি, মাছ ধরার জাল, রিকশা বা উপার্জনমুখী ব্যবস্থায় দান বা সহায়তা করেন, তাহলে সামাজিকভাবে সর্বোপরি রাষ্ট্রের মধ্যে ধনী-দরিদ্রের বিস্তর ব্যবধানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এভাবে সমাজের সব স্তরের মানুষ যদি ইসলামের নির্দেশিত পথে জাকাত আদায় করে, তাহলে আমাদের সমাজ থেকে বস্তিবাসী, ছিন্নমূল, টোকাই, পথশিশু, ভিক্ষুক, হিজড়া— মানবতার এমন নিষ্ঠুর পরিহাসসূচক বিশেষণের আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না।
লেখক : সাংবাদিক