ফিচার

দেশের সর্ববৃহৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

  • কানু সান্যাল, পাবনা  
  • প্রকাশিত ৬ নভেম্বর, ২০১৮

পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের ৫৭ বছর পর বাংলাদেশ পারমাণবিক জগতে প্রবেশ করেছে। রাশিয়ান ফেডারেশনের সহযোগিতায় ঈশ্বরদীর রূপপুরে পদ্মা নদীর তীরে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩০ নভেম্বর পারমাণবিক চুল্লি বসানোর কাজের অর্থাৎ ফার্স্ট কংক্রিট পোরিং ডেট বা এফসিডি কাজের উদ্বোধন করেন। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের রীতি অনুযায়ী ওই উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারমাণবিক জগতে প্রবেশ করে। চুক্তি অনুযায়ী ফার্স্ট কংক্রিট পোরিং ডেট বা এফসিডি উদ্বোধনের দিন থেকে ৬৩ মাসের মধ্যে এই প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হবে। বর্তমানে পৃথিবীর ৩১টি দেশে ৪৩৭টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এফসিডি কাজের উদ্বোধনের পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩২তম পারমাণবিক দেশ।

এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ড. ইয়াফেস ওসমান বলেন, পারমাণবিক শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে, যা দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরো সচল ও মজবুত করবে বলে তিনি আশা পোষণ করেছেন। এ সময় মন্ত্রী আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির লক্ষ্যে কবিতার ছন্দে বলেন, ‘চেষ্টা করিলে বাঙালি পারে না নেইকো এমন কাজ, পরমাণু থেকে বিদ্যুৎ গড়া আমরাও পারি আজ।’ তিনি আরো বলেন, এরই মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার আমরণ প্রচেষ্টা এবং বাস্তবায়িত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ভিশন-২০২১’।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পটভূমি : ১৯৬০ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে পদ্মা নদীর তীরে ঈশ্বরদীর রূপপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এ সময়কালে প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসনের জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করে ভূমির উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউজ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন এবং কিছু আবাসিক ইউনিট নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এটিকে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-৭৪ সালের দিকে এখানে ২০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর এই প্রকল্প অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। এম এস সোপরাটম ১৯৭৭-১৯৮৬ সালের মধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রটি তাড়াতাড়ি নির্মাণের পরামর্শ দেয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানির উদ্যোগে আরেকটি ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করা হয়। এই স্টাডি আগের স্টাডিকেই সমর্থন করে। এ সময় একনেকে ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থের জোগান না থাকায় এটি স্থগিত হয়। অর্থ সংগ্রহের জন্য জার্মানির সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জাতীয় জ্বালানি নীতি ১৯৯৬-এ রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সুপারিশ করা হয়। এ সময় দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া প্রকল্পটির বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৭-২০০০ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নকল্পে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যানের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়। সে সময় ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ঈশ্বরদীর রূপপুরে এসে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নকল্পে তিনি রূপপুরে এলে রূপপুরবাসী তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ায় আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ স্তিমিত হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পাদিত কার্যাবলি : ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের স্টেট অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশন (রোসাটোম) ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক ‘সমঝোতা স্মারক’ স্বাক্ষর করেন। ২০১০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং রাশিয়ান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি তত্ত্বাবধানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটি এবং সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ও আটটি সাব-গ্রুপ গঠন করা হয়। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাশিয়ান ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে প্রকল্প নির্মাণে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানান, প্রথম পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য প্রকল্পের শুরু থেকে মে মাস পর্যন্ত মোট ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৮১২ কোটি ৯ লাখ টাকা। এ পর্যায়ের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল প্রকল্পে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত ৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এ পর্যায়ে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। প্রকৌশল চুক্তি ও নির্মাণ শিডিউল অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে কাজ এগিয়ে চলেছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়ের কারণে এবং রাশিয়া নির্মিত প্রযুক্তির অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এরপরও যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেও যায়, সেক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় পদার্থ জনগণের নাগালের মধ্যে যাবে না। কারণ কোর ক্যাচার ব্যবহার করায় তেজস্ক্রিয় বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই। যে কারণে মডেলটি ঝুঁকিমুক্ত বলে তিনি জানিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিশমেন্টের কাজ শেষ। বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় অনেক গভীরে পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে কংক্রিট তৈরি করা হয়েছে। ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিংয়ের কাজ চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যেই শেষ হয়। মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ৭০ মিটার করে, আর ফাউন্ডেশনের থিকনেস হবে ৩ মিটার। আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজও দ্রুতগতিতে চলছে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পাওনিয়ার বেইজ ও ইরেকশন বেইজের কাজ শেষ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। চলছে প্রটেকশন ড্যাম (বাঁধ) নির্মাণের কাজ। ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার লম্বা এবং ১৩ মিটার প্রস্থ এ বাঁধের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে।

রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এই জমি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতোমধ্যে ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আরো ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। পদ্মার বিশাল চরে নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা জমিতে চলছে মাটিভরাটের কাজ। এখানে এখন রোলার, এক্সকেভেটর, পে-লোডার মেশিন ও ড্রাম ট্রাক চলাচলের দৃশ্য বিদ্যমান। 

পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ এমপি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ঈশ্বরদীবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশকে সমৃদ্ধিশালী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ও বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় জননেত্রী শেখ হাসিনা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল এই প্রকল্প অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads