পেট্রোবাংলা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ বর্তমানে গ্যাসের সংকট সামাল দিতে অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে গ্যাসফিল্ডগুলো ২/৩ বছরের মধ্যে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। যদি সাঙ্গু ও বাখরাবাদের মতো পরিণতি হয়, তাহলে তা সামাল দেওয়ার মতো বিকল্প নেই সরকারের হাতে। এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ খাতে। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ঘরে ঘরে বিদ্যুৎই তাদের গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে। কারণ গ্যাসের ওপর নির্ভর করে বর্তমানে বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খন্দকার সালেক সূফী বলেন, গ্যাসকূপগুলোর সাধারণত একটি ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করা থাকে। বাংলাদেশের কূপগুলোর গ্যাস উত্তোলনের ক্যাপাসিটি রয়েছে প্রায় ৩০ এমএমসিএফডির মতো। কিন্তু কিছু কূপ থেকে দ্বিগুণও উত্তোলন করা হচ্ছে। বিষয়টি গ্যাসফিল্ডের জন্য ভয়ানক হতে পারে। এমনকি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনেক নজির রয়েছে। বাংলাদেশের সাঙ্গু গ্যাসফিল্ড এভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। সাঙ্গুর উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১২০ এমএমসিএফডি, সেখানে ১৫০এমএমসিএফডি পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত উত্তোলনের কারণে প্রথমে পানি পরে বালি আসতে থাকে। তারপরও বিষয়টিতে মনোযোগ না দেওয়ায় ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় সাঙ্গু। বাখরাবাদ গ্যাসফিল্ডও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। নিকট অতীতে এত কিছুর পরও পেট্রোবাংলার হুঁশ হয়নি।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস রিজার্ভ বিবিয়ানা। দৈনিক উত্তোলিত গ্যাসের মধ্যে ৪৭.৫ শতাংশ (২৩ মে ২০২১) গ্যাস আসছে এই ফিল্ড থেকে। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন এই ফিল্ড থেকে অনেকদিন ধরে অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করছে। এতে গ্যাসের চাপ কমে এসেছে, সাঙ্গুর মতো বিবিয়ানাতেও পানি আসা শুরু হয়েছে। যে-কোনো সময় ফিল্ডটির গ্যাস উৎপাদন ব্যাপক কমে যেতে পারে।
শেভরন অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ ছাড়তে চায়। বছর তিনেক আগে তারা চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে চলে যেতে চেয়েছিল। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত উৎপাদন করে তাদের মুনাফা দ্রুত তুলে নিতে চায়। কারণ যত বেশি গ্যাস তুলবে তত দ্রুত তাদের বিনিয়োগ উঠে আসবে। গ্যাসফিল্ড বন্ধ হয়ে গেলে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হবে। একই অবস্থা বাঙ্গুরা গ্যাসফিল্ডেরও। এখানেও অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে করে গ্যাসের সঙ্গে পানি আসা শুরু হয়েছে। এই ফিল্ডটিও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সরকারের উচিত ফিল্ডগুলোর ওপর স্টাডি করে পরিকল্পনা নেওয়া। কূপের চাপ, রিজার্ভ ও চাহিদা রিভিউ করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এখনই গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করেছে।
এক সময় ২৭০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে। এখন ২৫০০ এমএমসিএফডির নিচে নেমে এসেছে। ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাস উৎপাদন বড় ধরনের হ্রাস পেতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পেট্রোবাংলার কোনো প্রস্তুতি দৃশ্যমান নয়। তারা এখনই গ্যাসের জোগান দিতে পারছে না। এলএনজি আমদানি করেও ঘাটতি সামাল দিতে পারছে না। গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে দ্রুত গতিতে, সেখানে যদি গ্যাস উৎপাদন হ্রাস পায় তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়ানো সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।
বর্তমানে ১০০০এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল ২০১৪ সালে। বাস্তবায়ন হতে ৫ বছরের বেশি সময় লাগে। ২০১৮ সালের আগস্টে প্রথম ইউনিট ৫০০ এমএমসিএফডি আনতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ইউনিট এসেছে ২০১৯ সালের এপ্রিলে। মাতারবাড়ীতে ১০০০ এমএমসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ড বেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে তা নিশ্চিত নয়। কারণ আমাদের দেশে নির্ধারিত সময়ে কোন কাজ শেষ হওয়ার নজির তেমন নেই। অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেলেও বাড়তি এলএনজি আমদানির পথ প্রায় বন্ধ।
অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে ২০২৩ সালের দিকে গ্যাসের সম্ভাব্য উৎপাদন হ্রাস মোকাবিলায় কোনো পরিকল্পনা আছে কি না-জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আইয়ুব খান চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) ভালো বলতে পারবেন। তার সঙ্গে কথা বলেন।
পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী আলী মো. আল মামুন বলেন, পিএসসির (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) মতামত নিয়েই অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। ২০২৩ সাল নাগাদ উৎপাদন হ্রাস মোকাবিলায় কী উদ্যোগ রয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি নতুন এসেছি, এ বিষয়ে ভালো করে না জেনে মন্তব্য করতে চাই না।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২৭টি গ্যাসফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে নিশ্চিত মজুতের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ। এ ছাড়া আরো ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুত। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসাবে মজুত অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ। প্রতি বছর উত্তোলিত হচ্ছে প্রায় ১ টিসিএফ।
গ্যাসের ঘাটতি কারণে এখনই হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সরবরাহ কমে গেলে, বিদ্যুতের উৎপাদন কমে গিয়ে বেড়ে যেতে পারে লোডশেডিং। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের এমন শঙ্কা সঠিক হলে সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ গলার কাঁটায় পরিণত হতে পারে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন এক সেমিনারে বলেছেন, আমাদের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ১১ হাজার মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রে ১৫শ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছি ১২শ এমএমসিএফডি (আগস্ট ২০২০), যা দিয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতে পারি। প্রায় ২৫ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকছে। গ্যাস থেকে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৮২৫০ মেগাওয়াটের মতো।
গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারত কয়লা উত্তোলন ও বেশি বেশি কূপ খনন করা। কিন্তু সেই ট্রেন মিস করেছে বলে মনে করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কয়লা এখনই না তোলার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। আর বেশি কূপ খনন থেকেও রয়েছে অনেকটা পিছিয়ে। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানও হতাশাজনক। জ্বালানি বিভাগের যখন বেহাল অবস্থা, তখন বিদ্যুৎ বিভাগ নতুন নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করে চলেছে।
২০১৬ সালের রিভাইস মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে ২৬৬১ মেগাওয়াট ও ২০২২ সালে ১১৮৮ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হওয়ার কথা। মতামত নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেও বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। ফোন করলেও রিসিভ করেননি। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব আনিসুর রহমানকে ফোন করে না পেয়ে এসএমএস দেয়। তাতেও সাড়া দেননি তিনি।





