এস এম হালিম মন্টু, নড়াইল
অবৈধ দখল আর দূষণের কবলে পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে নড়াইলের অপরূপ সৌন্দর্যের নদী চিত্রা। অপরূপ সৌন্দর্য আর শান্ত থাকার কারণে নড়াইলের তৎকালীন প্রভাবশালী জমিদাররা চিত্রাপাড়ে গড়ে তুলেছিলেন তাদের জমিদারি সাম্রাজ্য। শান্ত এই নদীতীরে বসে বিখ্যাত চিত্রকর এস এম সুলতান তার মনের ভাব প্রকাশ করেছেন ছবি আঁকার মাধ্যমে। তৎকালীন নড়াইলের জমিদার কালিশংকর রায় তাদের পরিবারের স্নান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ ও নৌভ্রমণের জন্য চিত্রাপাড়ে একটি বাঁধাঘাট নির্মাণ করেছিলেন, যা এদেশে দ্বিতীয়টি নেই । আর এ কারণে নড়াইলে ভ্রমণপিয়াসুদের নজর কাড়ে চিত্রা নদী।
নড়াইল জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নড়াইল শহরের শেখ রাসেল ব্রিজ থেকে এস এম সুলতান ব্রিজ পর্যন্ত চিত্রা নদীর পাড়ের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় ছোট-বড় মিলে ৬৩টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হলেও কমপক্ষে ১০০ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে বলে নদী বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা দাবি করেছেন। চিত্রার অধিকাংশ জায়গা দখল আর দূষণের ফলে নদীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দখলের জন্য একশ্রেণির সরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকেরা সরকারি খাস জমি দেখিয়ে জমি দখল করে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলে বসবাস করছেন। মাঝে মধ্যে নদী বাঁচাও আন্দোলনকারীদের চাপে পড়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাপামাপি শুরু হলেও তা অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে যায়। আবার নতুন করে শুরু হয় নদী দখলের উৎসব। এভাবে চিত্রা নদীর পাড়ে নড়াইল শহরে অন্তত ১০০ বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে প্রশাসনের সামনে।
এ ছাড়া নদীপাড়ের অন্তত হাজার বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপ দেওয়া হয়েছে নদীর ভেতরে বলেও নদী বাঁচাও আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন। চিত্রাপাড়ে নড়াইল শহর গড়ে ওঠায় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আবাসিক সকল এলাকার মানুষ জেনে হোক আর না জেনে হোক তাদের ব্যবসা ও পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা সকল ময়লা-আর্বজনা নদীবুকে ফেলে নদী ও নদীর পানিকে নষ্ট করে আসছে। এরপর রয়েছে প্রতি বছর পাট কাটা মৌসুম। কৃষকরা পাট কেটে তা পচাতে চিত্রা নদীকে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে। ওই সময় পাট পচানোর কারণে পানি নষ্ট হয়ে নদীর সকল প্রকার মাছ মারা যায়। শুধু তাই নয়, তখন কোনো মানুষ নদীর পানি ব্যবহার করতে পারে না।
নড়াইল সিটিজেনস ভয়েসের সমন্বয়ক কাজী হাফিজুর রহমান বলেছেন, ভূমিদস্যু ও দখলদারদের হাত থেকে চিত্রা নদীকে বাঁচানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চিত্রা নদীকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। চিত্রা নদীকে বাঁচানোর জন্য প্রশাসন যদি দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে চিত্রা নদী অচিরেই তার রূপ হারাবে।
নড়াইল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মীর্জা নজরুল ইসলাম বলেছেন, নড়াইলের কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রভাবশালী একটি চক্র অবৈধভাবে চিত্রা নদীর পাড় দখল করে অট্টালিকা গড়ে তুলেছে। চিত্রা নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে হলে সঠিকভাবে আইনি সহায়তার মাধ্যমে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এ ছাড়া যারা চিত্রা নদীতে পাইপের মাধ্যমে পয়ঃনিষ্কাশন করছেন তাদের আইনের আওতায় এনে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, প্রতি বছর পাট কাটা মৌসুমে নদীর যেখানে সেখানে পাট পচানো হয়। এ সময় পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায় এবং নদীর অসংখ্য প্রজাতির মাছ মরে যায়। তিনি চিত্রা নদীকে বাঁচাতে নড়াইল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
নড়াইল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আজিম উদ্দিন জানান, সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শহরের চিত্রা নদীতীরবর্তী এলাকায় এক জরিপে ৬৩ জন নদীপাড় দখল করে আছে বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে ২০১৮ সালের মার্চ মাসের ৮ তারিখে নোটিশ করা হয়েছে। নোটিশে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থাপনা সরিয়ে না নেওয়া হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।