কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের খুকী ও কাঠবিড়ালী কবিতাটির কথা সবারই মনে আছে। পেয়ারা কাঠবিড়ালীর প্রিয় ফল। তবে মানুষের জন্য পেয়ারা কতটা উপকারী তা জানুন আজকের আলোচনায়।
পেয়ারা বাংলাদেশের অতি পরিচিত একটি ফল। দেশের প্রায় সবখানেই পাওয়া ফলটি। মূলত বর্ষাকালীন ফল এটি। কাঁচা অথবা পাকা উভয় অবস্থায়ই পেয়ারার ত্বক থাকে গাঢ় সবুজ। গাছের সবুজ পাতার চেয়ে কোনো অংশেই কম সবুজ নয় ফলটি। তাই গাছে ফলটি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। তবে পাকা ফলের শাঁস সাধারণত লাল হয়ে থাকে।
আমাদের ত্বককে ক্ষতিকর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করে পেয়ারার বাইরের সবুজ ত্বক। পেয়ারায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ময়েশ্চার, যা তারুণ্য বজায় রাখে দীর্ঘদিন, ত্বকের রুক্ষ ভাব দূর করে এবং শীতে পা ফাটা রোধ করে। রোগ প্রতিরোধে পেয়ারার অনেক গুণ। পেয়ারা একটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধি গুণসম্পন্ন ফল এবং এতে প্রচুর ভিটামিন-সি আছে। পেয়ারায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও পলিফেনল যা ক্যানসার প্রতিরোধক। পেয়ারার বীজে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ পলিআন-সেচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ও আঁশ বিদ্যমান। পাতার রস ক্যানসার প্রতিরোধী এবং সংক্রমণ, প্রদাহ, ব্যথা, জ্বর, বহুমূত্র, আমাশয় প্রভৃতি রোগে ব্যবহূত হয়ে থাকে। ফল হিসেবে খাওয়ার পাশাপাশি পেয়ারা দিয়ে জেলি, জ্যাম ও জুস তৈরি করা হয়ে থাকে।
আপেল-কমলার চেয়ে উত্তম পেয়ারা : আমরা জানি আপেলে ভিটামিন ‘সি’ আছে। পেয়ারায়ও ভিটামিন ‘সি’ আছে। কিন্তু জানি না কোনটিতে কী পরিমান ভিটামিন ‘সি’ আছে। আসুন জেনে নিই- খাবারযোগ্য ১০০ গ্রাম আপেলের মধ্যে ভিটামিন ‘সি’র পরিমাণ ৪০ আইইউ (আন্তজাতিক একক) এবং একই পরিমাণ পেয়ারায় অর্থাৎ ১০০ গ্রাম খাবারযোগ্য পেয়ারায় ভিটামিন ‘সি’র পরিমাণ ৬০০ আইইউ। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, একটি পেয়ারায় রয়েছে চারটি কমলালেবুর সমান পুষ্টি। তাই সপ্তাহে একটি হলেও পেয়ারা খাওয়া উচিত। দেখা গেছে, পুষ্টিমানের বিবেচনায় কমলার মান যেখানে ১৮৬ পয়েন্ট, সেক্ষেত্রে পেয়ারার পুষ্টি মূল্যমান ৪২১ পয়েন্ট। পেয়ারায় কমলার চেয়ে চারগুণ বেশি ভিটামিন সি আছে। পেয়ারার খোসায় কমলার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। পেয়ারায় লৌহ উপাদানও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান।
পেয়ারা একধরনের সবুজ রঙের বেরি জাতীয় ফল। যদিও ভিন্ন বর্ণের পেয়ারাও দেখতে পাওয়া যায়। লাল পেয়ারাকে (Marroonguava) রেড আপেলও বলা হয়। পেয়ারার বৈজ্ঞানিক নাম Psidiun guajava। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রভৃতি স্থানে পেয়ারা বেশি জন্মে। পেয়ারার প্রায় ১০০টিরও বেশি প্রজাতি আছে। এটি একটি পুষ্টিকর ফল। এটি ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস, ফোলেট, পটাশিয়াম, আঁশ এবং ক্যালসিয়াম প্রভৃতিতে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের সব জায়গায়ই কম-বেশি পেয়ারা জন্মে। বাণিজ্যিকভাবে বরিশাল, ফিরোজপুর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি প্রভৃতি এলাকায় এর চাষ হয়ে থাকে। বিভিন্ন জাতের দেশি পেয়ারা চাষের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিভিন্ন উন্নত জাতের পেয়ারার চাষ হচ্ছে দেশের অনেক জায়গায়। বাংলাদেশে পেয়ারার অনেক জনপ্রিয় জাত রয়েছে। উল্লেখযোগ্য জাতগুলো- কাজি পেয়ারা, বারি পেয়ারা-২, বারি পেয়ারা-৩, বাউ পেয়ারা-১ (মিষ্টি), বাউ পেয়ারা-২ (রাংগা), বাউ পেয়ারা-৩ (চৌধুরী), বাউ পেয়ারা-৪ (আপেল), ইপসা পেয়ারা-১, ইপসা পেয়ারা-২, কাঞ্চন নগর, মুকুন্দপুরী, থাই পেয়ারা, পলি পেয়ারা, আঙ্গুর পেয়ারা ইত্যাদি।
১০০ গ্রাম পেয়ারায় আছে- ভিটমিন-সি ৩৭৭ মিলিগ্রাম, পানি ৮৬.১০ গ্রাম, শক্তি ৫১ কিলোক্যালরি, প্রোটিন ০.৮২ গ্রাম, আঁশ ৫.৪ গ্রাম, ফসফরাস ২৫ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৩ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন-এ ৭৯২ আইইউ থাকে। পেয়ারায় ম্যাঙ্গানিজ, সেলিনিয়াম, ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, ময়েশ্চার ১৩৩ গ্রাম, ডায়াটারি ফাইবার ৮.৯ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেড ২৩.৬ গ্রাম, পটাশিয়াম ৬৮৮ মিলিগ্রাম।
কেন খাবেন পেয়ারা
১. পেয়ারা একটি উচ্চ পুষ্টিমানের ফল। ভিটামিন-সি হলো একটি প্রধান অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যেটি কোষকে ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ থেকে রক্ষা করে। শুধু তা-ই নয়, ভিটামিন-সি আমাদের শরীরের ত্বকে বয়ে আনে পুষ্টি।
২. পেয়ারার ভেতরের চেয়ে বাইরের খোসায় রয়েছে বেশি পরিমাণে ভিটামিন-সি, যা স্কার্ভি নামক চর্মরোগসহ নানা ধরনের ত্বকের অসুখের বিরুদ্ধে কাজ করে।
৩. মুখের রুচি বাড়াতে সহায়ক। সর্দি, হাঁচি, কাশি দূর করতেও পেয়ারার জুড়ি মেলা ভার।
৪. পেয়ারায় রয়েছে যথেষ্ট ক্যারোটিনয়েড নামক পুষ্টি উপাদান, যেটি ভাইরাসজনিত ইনফেকশন থেকে আমাদের রক্ষা করে।
৫. ডায়রিয়ার জীবাণুকে করে দুর্বল।
৬. পেয়ারার ভিটামিন দৃষ্টিকে করে শক্তিশালী।
৭. পেয়ারায় বিদ্যমান খনিজ উপাদান পটাশিয়াম ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে এবং ম্যাগনেসিয়াম শরীরের কোষের দুর্বলতা দূরীকরণে উপকার দেয়।
৮. আমাদের ত্বকে টানটান ভাব আনয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে পেয়ারা। এতে তারুণ্য বজায় থাকে দীর্ঘকাল।
৯. পেয়ারায় ইনফেকশনরোধী উপাদান থাকায় ডিসেন্ট্রি প্রতিকারে, হজমক্রিয়া শক্তিশালী করতে এবং গ্যাস্ট্রো-এন্টারাইটিস রোগে বিশেষ উপকারী।
১০. পেয়ারায় যথেষ্ট পরিমাণে পেকটিন থাকায় তা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
১১. অ্যাজমা, ঠান্ডা-কাশিতে কাঁচা পেয়ারার জুস উপকারী।
১২. দাঁতব্যথা, দাঁতের ক্যারিজ, মাঢ়ি ফোলা, স্কার্ভি, মুখের ঘা ইত্যাদিতে পেয়ারা মহৌষধ।
১৩. খিঁচুনি, এপিলেপসি প্রতিকারে পেয়ারা উপকারী।
১৪. রক্তের সঞ্চালনে ঘাটতি এবং দীর্ঘমেয়াদি মিনস্ট্রুয়েশনে পেয়ারার ভূমিকা কার্যকর।
১৫. ওজন কমাতে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, রুচি বাড়াতে পেয়ারার জুড়ি নেই।
পেয়ারা পাতায় চা : পেয়ারা গাছের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। পেয়ারা পাতারও রয়েছে বিশেষ গুণ। পেয়ারা পাতা দিয়ে এক ধরনের চা তৈরি করেছে জাপান যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেয়ারা পাতার চা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিক রোগী তাদের কাছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এই চা মানবদেহ সতেজ করে, দাঁত মজবুত ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। পেয়ারা পাতা প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। শুধু তার ব্যবহার ও উপযোগিতা জানলেই হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশি পেয়ারা পাতার বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পেয়ারা পাতার চায়ে কোনো ধরনের কৃত্রিম ফ্লেভার বা রঙ ব্যবহার করা হয় না। প্রতি কেজি পেয়ারায় ৬৬০ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। পেয়ারা গাছের ছালের ক্বাথ ছোটদের উদরাময় রোগে ব্যবহার করা হয়।
জেনে রাখুন : ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য খুব বেশি মিষ্টি পেয়ারা খাওয়া উচিত নয়। কারণ এটি ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের কচি পেয়ারা খাওয়া ভালো। কারণ তা তাদের রক্তে চিনির মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। পেয়ারার ভিটামিন-এ ছোটদের রাতকানা রোগ ভালো করে। তবে বাচ্চারা পেয়ারার বিচি হজম করতে পারে না। তাই তাদের বিচি বাদ দিয়ে পেয়ারা খাওয়ানো উচিত। প্রতিদিন একটি আধাপাকা পেয়ারা খাবেন। বিচিসহ বেশি পরিমাণে পেয়ারা খেলে হজমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই বিচি ফেলে খেতে পারেন। গোলাপি পেয়ারা বেছে নিন, এতে পুষ্টিমান কিছুটা বেশি। পেয়ারা বঁটি দিয়ে না কেটে দাঁত দিয়ে কামড়ে খান।