তাঁতের শাড়ীর কদর না থাকায় মন্দার কবলে পড়েছে পাবনার তাঁতশিল্প। দেশে বিদেশে তাঁতবস্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় পাবনা অঞ্চলের তাঁত মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র বিশেষ করে শাড়ী বিক্রিতে অব্যাহত লোকসানে মালিকরা তাঁত কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। শীতের আগমনে পাইকারী বাজারে শীতবস্ত্রের চাহিদা থাকায় শাড়ী ও লুঙ্গীর উৎপাদন হ্রাস করেছে তাঁত মালিকরা। শাড়ী তৈরীতে অনেকেই পুঁজি হারিয়ে পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। হাজার হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছেন।
তাঁত কারখানা মালিকরা বলছেন, এভাবে লোকসান অব্যাহত থাকলে তাঁত শিল্প এবং এ শিল্পের সাথে জড়িতরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে রফতানি এবং দেশে চাহিদা কমে যাওয়ায় তাঁতে তৈরী শাড়ীর বাজার দর প্রতিদিন নিন্মমুখি হচ্ছে। সরকারিভাবে পদক্ষেপ না নেয়া হলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরো প্রকট আকার ধারন করবে। অনেকেই মত প্রকাশ কররেছেন, গৃহবধুদের পড়নে আর তাঁতের শাড়ী দেখা যায়না, এখন সকল শ্রেণী পেশার নারীরা সালোয়ার কামিজ বা প্রিন্ট শাড়ী বেশী ব্যবহার করায় তাঁতের শাড়ীর ব্যবহার কমে গেছে। আর এতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তাঁত কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিদেশে তাঁতবস্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় তাঁতে উৎপাদিত শাড়ী বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাঁতের তৈরী লুঙ্গী ভারতে ও দেশে চাহিদা থাকায় শাড়ী তৈরী বন্ধ রেখে লুঙ্গী তৈরী করছেন তাঁত মালিকেরা। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশী হওয়ায় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে তাঁতিরা লাভবান হতে পারছেনা। বিশেষ করে প্রান্তিক তাঁতিরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। মহাজনের কাছ থেকে বাকীতে রং, সূতা নিয়ে অনেকেই ঋণী হয়ে পড়েছে, ঋণ পরিশোধ ব্যর্থ হয়ে অনেকেই তাঁত বিক্রি করে পোষাক শিল্পে, কেউবা অন্য কোন শিল্প কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছে। কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বর্তমানে পাবনা অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ঋণগ্রহিতরা তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। বিদ্যুৎ চালিত পাওযারলুমের চাহিদা থাকায় হস্তচালিত তাঁত বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই তাঁতের কাঠ জ্বালানি হিসেবে, লোহা ভাঙ্গড়ীর দোকানে বিক্রি করছেন। তাঁত শ্রমিক আলামিন, জব্বার, মর্জিনারা বলেন, হস্তচালিত প্রতিটি তাঁতের জন্য একজন করে শ্রমিক নিয়োজিত থাকে এবং দিনে ৩টি মোটা শাড়ী বা ৪ থেকে ৫টি লুঙ্গী তৈরী করে থাকে। বিদ্যুৎ চালিত পাওয়ারলুমে ১জন শ্রমিক ২টি পাওয়ারলুম চালাতে পারে এবং প্রতি তাঁতে ৬টি শাড়ী বা ৮ থেকে ৯টি লুঙ্গী তৈরী করে থাকে।
পাবনা তাঁত সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে দেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশে পরিচিত। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পাবনার সাঁথিয়া বেসিকসেন্টার সূত্রে জানা গেছে, জেলার সাঁথিয়া, সুজানগর, বেড়ায় উপজেলায় তাঁতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। তাঁত বোর্ডের জরিপ অনুযায়ী হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা ১৫বছর পূর্বে ছিল প্রায় ৫৫ হাজার, বর্তমানে তা ৭০শতাংশ নিচে নেমে এসেছে এবং বিদ্যুত চালিত পাওয়ারলুমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০ হাজার হয়েছে। এই তাঁত শিল্পের সঙ্গে শ্রমিক জড়িত রয়েছে প্রায় দেড় লাখ নারী পুরুষ শ্রমিক। এছাড়া ব্যবসা ও অন্যান্য পেশার লোকজন তাঁতশিল্পের উপর নির্ভরশীল। তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে শাহজাদপুর ও আতাইকুলায় গড়ে উঠেছে দেশের মধ্য বৃহৎ দু’টি কাপড়ের হাট।
আতাইকুলা ও শাহজাদপুর হাটে প্রতি সপ্তাহের চারদিন (দিনরাত মিলে) কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাপড় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা এই হাটে এসে শাড়ী, লুঙ্গি ক্রয় করে থাকেন। প্রতিহাটে ভারতে লুঙ্গি ও কিছু শাড়ী রফতানি হয়ে থাকে। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হতো। বর্তমানে কাপড় ক্রয়-বিক্রয়, রফতানী ও ব্যাংক লেনদেন অর্ধেকের কমে নেমে এসেছে বলে স্থানীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়।
বেড়ার রাকশা গ্রামের নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন তাঁত মালিক জানান, পুঁজি হারিয়ে তাঁত বিক্রি করে দিয়ে রাতের আধারে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি। এলাকায় এক সময় প্রচুর দাপট ছিলো। অনেক দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করেছি। এখন নিঃস্ব হয়ে মানসন্মানের ভয়ে বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়েছি। বেড়ার হাতিড়াগাড়া,সান্যাল পাড়া গ্রামে ৫টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। তাঁতী শফিকুল ইসলাম জানান, কাপড় বিক্রি করে শ্রমিকের মজুরীর টাকাই জোগাড় হচ্ছেনা। গুদামে লাখ লাখ টাকার কাপড় মজুদ হয়ে আছে। জমি বিক্রি করে বাংকের সুদের ১৬ লাখ টাকা দিয়েছি। মোট ৩০৪ টি তাঁতের মধ্যে মাত্র ৯৫টি তাঁত চালু রেখেছি।
রফতানিকারক মেসার্স রায় ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকার নিত্যনন্দ রায় বলেন, শুল্কমুক্ত হওয়ায় ছয়টি রফতানীকারক প্রতিষ্ঠান আতাইকুলা ও শাহজাদপুরের হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে চার লাখ পিচ শাড়ী ও লুঙ্গী ভারতে রফতানী করতো। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে কাপড় রফতানী হতো। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জর জেলার কাপড় ব্যবসায়ী বাসুদেব কুন্ডু বলেন,তিনি আগে শাহজাদপুর ও আতাইকুলা থেকে লুঙ্গির চেয়ে শাড়ী বেশী কিনতেন কিস্তু বর্তমানে ভারতে বাংলাদেশী সাধারণ তাঁতের শাড়ীর চাহিদা না থাকায় এবং লুঙ্গির চাহিদা বেশী থাকায় তিনি লুঙ্গি আমদানী করে থাকেন। গত ৩ বছর ধরে ভারতের রাজ্য সরকার ছয় শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে রফতানীর পরিমান অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া না হলে এই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করবে।