তরুণ ব্যাংকারদের ক্যারিয়ার ভাবনা

বাংলাদেশ ব্যাংক

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

তরুণ ব্যাংকারদের ক্যারিয়ার ভাবনা

  • প্রকাশিত ২৯ অক্টোবর, ২০১৮

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদ অনেক তরুণের কাছে স্বপ্ন। প্রতিবছর কঠোর পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে অল্পসংখ্যক প্রার্থী এ স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী এই স্বপ্নের ক্যারিয়ারে পদার্পণ করেন। পুরান ঢাকার এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন স্বপ্নবাজের কথা জানাচ্ছেন এম এম মুজাহিদ উদ্দীন

Hasibur Rahman Emile

হাসিবুর রহমান এমিল

ছাত্র হিসেবে বরাবরই ভালো ছিলেন। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান। মাস্টার্সের থিসিসের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এনএসটি ফেলোশিপ পান। সবেমাত্র অনার্স শেষ হয়েছে। তখন জিআরই’র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সহপাঠী (বর্তমানে স্ত্রী) ফারহানার উৎসাহে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেন। প্রিলিমিনারিতে টিকে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাপারে অনেক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন এটি দেশের অন্যতম শীর্ষ চাকরি এবং এখানে রয়েছে দারুণ কর্মপরিবেশ আর বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ। এমিল বলেন, ‘ভাইভা বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্রমাগত উন্নতি নিয়ে অনেক প্রশংসা শুনলাম। বোর্ডের চেয়ারম্যান স্যার আমি ঢুকতেই বললেন, ‘আরে জগন্নাথের এরা কি দলবেঁধে পরীক্ষা দিতে আসছে নাকি?’ মনে মনে বললাম, ‘আসছে ফালগুনে আমরা দ্বিগুণ হব। ভাইভা দিয়ে বের হলাম আর মনে হলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা বেশ ভালো করছে দিন দিন।’

Sabekunn nahar shrin

সাবেকুন নাহার শিরিন

যতটা সফল হয়েছেন, তার পেছনের গল্পটা বেশ সাধারণ- বলছিলেন শিরিন। তিনি জয়ী হতে চেয়েছেন, অনেক বার হেরেছেন; কিন্তু জেতার নেশাটা এখনো হারাননি। আজো যুদ্ধ করছেন ভালো কিছু করার। তিনি জানেন, হয়তো কখনো কখনো হেরে যাবেন; কিন্তু জেতার নেশাটাই তাকে জয়ী করে তুলবে- বিশ্বাস করেন শিরিন। শিরিনের আত্মবিশ্বাসও ছিল অনেক। প্রিলিমিনারির সময় ইংরেজি, গণিত, কম্পিউটার- এই বিষয়গুলোতে বিশেষভাবে প্রিপারেশন নিয়েছেন। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কুইজে অংশ নিয়েছেন। প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার সময় ব্যবস্থাপনা আগেই করেছিলেন, যে কারণে সময় শেষ হওয়ার আগেই পরীক্ষা শেষ করতে পেরেছেন। শিরিন  বলেন, ‘সময় ব্যবস্থাপনা অনেক বড় একটি ফ্যাক্টর। ভাইভার জন্য নিজের গ্র্যাজুয়েশন বিষয়ের ওপর বিশেষ ধারণা থাকা জরুরি। আমার বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বাবার স্বপ্ন পূরণে তার অনুপ্রেরণায় পরিশ্রম করে গেছি নিরন্তর।’

Rasel Sarder

মো. রাসেল সরদার

পড়তে শেখার পর টাকার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক নামক প্রতিষ্ঠানের নাম দেখেছি। দেশের এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা হতে পেরে আজ আমি গর্বিত- কথাগুলো বলছিলেন রাসেল। রাসেল স্কুলে কখনো গণিতে ৮০’র নিচে পাননি, আর ইংরেজিতে ৪০-এর উপরে পাননি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যায় ভর্তি হয়ে শুরু করলেন ইংরেজি-ভীতি দূর করার চেষ্টা। কয়েক বছর লেগে থেকে একসময় ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে  উঠলেন। অনলাইনে প্রতিদিন নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান পড়তেন। গণিত ও ইংরেজিতে সমানভাবে দক্ষতা অর্জন করে আত্মবিশ্বাসী হয়েছিলেন। অনার্স প্রথম বর্ষ থেকেই চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ায় অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রথমে এবি ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার পদে চাকরি পেয়েছেন। সেখানে প্রায় ২ বছর চাকরি করেছেন। এরপর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রায় দেড় বছর চাকরি করেছেন।

Asif Hossen

আসিফ হোসেন

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উপস্থাপনার প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) তালিকাভুক্ত হন সংবাদ পাঠক হিসেবে। ২০১৫ সালে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসে এমবিএ শেষ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মূলত তার বাবার উৎসাহেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক (জেনারেল) পদে আবেদন করেন। ২০১৮-তে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগের আগে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন আরো একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ৯ বছর আইইএলটিএস এবং টোয়েফলের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। অনুজদের উদ্দেশে তিনি বলতে চান, সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ খুব জরুরি। তার চাইতেও বেশি জরুরি সেই লক্ষ্য অর্জনে নিরলস কাজ করে যাওয়া। তাহলে দ্রুত হোক বা দেরিতে, সৃষ্টিকর্তার আনুকূল্য থাকলে, সাফল্য আসবেই।

Maruful Azam Riyad

মারুফুল আজম রিয়াদ

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ হওয়ার কারণে সিনিয়রদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। আবার নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, সেটাই জানত না বা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখত। সেজন্য চাকরির বাজারে রিয়াদকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। ১৯তম ভাইভায় গিয়ে চাকরির দেখা পেয়েছেন। রিয়াদ বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনেক ভালো অবস্থানে যাচ্ছে এবং আছে।’ চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। এরপর জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হবেন। অবশেষে ২০১৮ সালে স্বপ্নের চাকরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান।

Masudur Rahman

মো. মাসুদুর রহমান সজীব

ব্যাংকারই হতে চেয়েছিলেন। কারণ ব্যাংকারদের কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদসহ সবকিছুই তাকে আকৃষ্ট করতো। তবে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি করবেন- এমনটা কখনোই ভাবেননি। ২০১৫ সালের শেষের দিকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে ক্যারিয়ার গড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং সম্পর্কে যতই জানতে লাগলেন, ততই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকল। একসময় বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বপ্ন হয়ে উঠল। এ স্বপ্ন পূরণে যখনই যেখানে সুযোগ পেতেন, পড়াশোনা করতেন। মাসুদ বলেন, ‘প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা- এই তিন ধাপে প্রায় আড়াই বছর শেষ করে ২০১৮ সালের ২৩ মে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করল, তখন নিজের রোলটা সেখানে দেখে মুখে কোনো কথা বের হচ্ছিল না, শুধু কাঁপছিলাম! স্বপ্ন দেখেছি, আল্লাহর কাছে চেয়েছি আর পড়াশোনা করেছি, সফল হয়েছি।’

Bidhan Chandre Sarder

বিধান চন্দ্র সরদার

স্কুল পরিবর্তন। প্রথমবার এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর সেশনজট। দুই বছর মেয়াদি এমবিএ ইত্যাদি কারণে সমবয়সীদের চেয়ে প্রায় পাঁচ বছর পিছিয়ে পড়েন। তবু স্বপ্ন দেখেন নর্থ আমেরিকান পিএইচডি ডিগ্রির। জিআরই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু পরিবারে মা ছাড়া আর কেউ না থাকায় পাঁচ বছরের জন্য তাকে একা রেখে দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয়। পিছিয়ে পড়া সময় পুষিয়ে নিতে দ্রুত চাকরি পাওয়ার জন্য জিআরই প্রস্তুতির সঙ্গে মিল রেখে ব্যাংক জবের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। চাকরি পেয়ে যান এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে; কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ করেননি। স্বপ্নের চাকরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালকের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সারাদিন অফিস শেষে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত চলত পড়ালেখা। দুই বছর সাধনার পর ধরা দেয় স্বপ্ন। কিন্তু নর্থ আমেরিকান পিএইচডি ডিগ্রির স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। আশা এখনো ছাড়েননি।

Mohiuddin Jahangir

মো. মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পাবেন এরকম স্বপ্ন দেখেননি। এটা ছিল মূলত তার বাবার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন এতেই তিনি খুশি। কিন্তু এর জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। এর আগে তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে পাঁচ বছর চাকরি করেছেন। মহিউদ্দীন বলেন, ‘চাকরির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদের জন্য বাড়তি পড়ালেখা খুব সহজ ছিল না, আর সঙ্গে সংসার জীবন তো ছিলই। আসলে আমার স্ত্রীর অনুপ্রেরণাই এক্ষেত্রে সাহস জুগিয়েছে। সবশেষে ছিল আত্মবিশ্বাস।’ তিনি মনে করেন স্বপ্ন, অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস- এই তিনকে পুঁজি করে সঠিক পরিশ্রম করলে যে কোনো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নিয়োগের মাধ্যমে তিনি তার প্রিয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে ধরতে পেরেছেন- এটা ভেবে তিনি গর্বিত।

Sajedul Islam

মো. সাজেদুল ইসলাম

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ২০০৮-২০০৯ সেশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল না থাকায় শুরুতে কিছুটা মন খারাপ ছিল সিনিয়রদের গাইডলাইন পাবেন কি-না এই সংশয়ে। পরে মা মঞ্জিলে থাকার সুবাদে তা কেটে যায়। বিভাগের শিক্ষকদের বন্ধুসুলভ ব্যবহার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা চলে আসে। চতুর্থ বর্ষ থেকে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। সাজেদুলের পছন্দের মধ্যে ছিল ব্যাংক অথবা বিসিএস। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি শুরু করেন। তার ফলস্বরূপ ২০১৫ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদের সার্কুলারে এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৮ সালে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads