অনেকেই হয়তো শুনলে অবাক হবেন, টাকারও জাদুঘর হয়! বেরসিক কেউ শুনলে উত্তর দেবেন, কেন হয় না? টাকারও তো রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য। হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুদ্রা কীভাবে আজকের কাগুজে টাকা হলো, তা কি জানতে ইচ্ছে করে না আপনার! তাহলে চলুন একদিন ঢাকার মিরপুরে। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে নেমে রিকশা নেবেন। তারপর মিরপুর-২-এ বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমিতে চলে যাবেন। এর দোতলায় বিরাট দুটি গ্যালারি নিয়ে খোলা হয়েছে টাকার জাদুঘর। জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয় ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর। পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশেই টাকার জাদুঘর আছে। বাংলাদেশও টাকার জাদুঘর করে বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থার ইতিহাস ধারণ করল।
এখানে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন আমলের মুদ্রা থেকে বর্তমান টাকার বিবর্তনের যাবতীয় ইতিহাস। গ্যালারি ১-এ প্রদর্শিত হচ্ছে উপমহাদেশের বিভিন্ন শাসনামলে প্রচলিত মুদ্রা। এর মধ্যে রয়েছে প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, হরিকেলের মুদ্রা, ইন্দো-পার্থিয়ান মুদ্রা, কুশান মুদ্রা, কুচবিহারের মুদ্রা, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের মুদ্রা, মোগল সম্রাটদের মুদ্রা। আরো রয়েছে মোগল শাসন সমাপ্তির পর ১৮৩৫ সাল থেকে প্রচলিত ব্রিটিশভারতীয় মুদ্রা। প্রাচীন বাংলায় ব্যবহূত বেশকিছু কড়িও প্রদর্শিত হচ্ছে এ গ্যালারিতে। গ্যালারি ২-এ প্রদর্শিত হচ্ছে বর্তমান সময়ের যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশের মুদ্রা। মুদ্রার পাশাপাশি এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রাচীন মুদ্রা দ্বারা নির্মিত অলংকার, মুদ্রা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহূত কাঠের বাক্স, লোহার তৈরি কয়েন ব্যাংক এবং লোহার সিন্দুক প্রভৃতি। এ ছাড়া শস্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহূত মাটির মটকাও প্রদর্শিত হচ্ছে এ জাদুঘরে।
কালে কালে অনেক দেশের অনেক মুদ্রা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু মুদ্রা নয়, বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক দেশ, রাষ্ট্র, জনপদ। সেসব হারিয়ে যাওয়া দেশ-জনপদের স্মৃতি অঙ্কিত আছে সে সময়ের মুদ্রায়। সে ধরনের কিছু প্রাচীন, ঐতিহাসিক মুদ্রাও সংরক্ষিত আছে এ জাদুঘরে। যেমন কেমন ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লোভাকিয়া, ব্রিটিশ বার্মা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মুদ্রা। এ জাদুঘরে গেলে আপনি তাও দেখতে পাবেন। শুধু তা-ই নয়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের প্রাচীন বাংলার সভ্যতা উয়ারী-বটেশ্বরের মুদ্রাও সংরক্ষিত আছে এ জাদুঘরে।
জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক সংগ্রাহক তার মূল্যবান মুদ্রাটি এ জাদুঘরে উপহার হিসেবে দান করেছেন। এ ছাড়া বেশকিছু মুদ্রা কেনা হয়েছে। কেনা ও সংগ্রহ করা মুদ্রার সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। টাকার জাদুঘর বাস্তবায়ন উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। চিত্রশিল্পী হাশেম খানের সভাপতিত্বে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, স্থপতি রবিউল হুসাইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুমারের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি পুরো কাজের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তদারকি করেন।
টাকার জাদুঘর খোলা থাকে শনি থেকে বুধবার বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। কোনো প্রবেশ ফি নেই। জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীদের কাছে বড় আকর্ষণ ফটো কিয়স্ক। ফটো কিয়স্কের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের আবক্ষ ছবি বিশেষ একটি স্যুভেনির নোটে প্রতিস্থাপন করে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।