প্রায় তিন দশক পর ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে বড় মূল্যায়ন হলো— দীর্ঘ ২৮ বছর পর ছাত্ররাজনীতির অচলায়ত্ব ভেঙেছে। আশাবাদী হওয়া যায়, এর মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক জড়তার অবসান হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন যেমন হওয়ার কথা এবং ডাকসু নির্বাচনের অতীত ইতিহাস যা বলে, এবারের নির্বাচন সে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও অতীত ঐতিহ্য কোনোটাই রক্ষা করতে পারেনি। এটাকে গণতন্ত্র ও ডাকসুর জন্য একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়ও বলা যায়। তবে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসি (উত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন) নির্বাচন ও কয়েকটি উপজেলা নির্বাচনের যে হাল আমরা দেখেছি, সে তুলনায় ডাকসু নিয়ে ভিন্ন কিছু আশা করাটাই বা কতটুকু যৌক্তিক তাও ভাবার বিষয়।
ডাকসু নিয়ে সারা দেশে একটা ভিন্ন দৃষ্টি ও আশা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের দিন সিলমারা ব্যালট, কৌশলে ভোটদানে বাধা দেওয়া, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও ঢাবি প্রশাসনের পক্ষপাত সে আশার গুড়ে বালি দিয়েছে। ভোটগ্রহণের দিনে যা হয়েছ তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। রোকেয়া হলে ও কুয়েত-মৈত্রী হলের ঘটনা এবং ছাত্র হলগুলোতে জটলা পাকিয়ে সাধারণ ছাত্রদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখার কৌশল গণমাধ্যমের বদৌলতে সারা দেশের মানুষ দেখেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হওয়া একজন ছাত্রীর ক্ষোভ ছিল দাগ কাটার মতো— ‘আমরা এমন শিক্ষকদের কাছে কী শিখব’ কথাটা বলেছিল যখন শিক্ষকদের নিষ্ক্রিয়তা ও প্রশাসনের নির্লজ্জ দায়িত্বহীনতার কারণে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন কর্তৃক সিলমারা ব্যালট ও কেন্দ্রের ভিতরে ভিপি প্রার্থীর ওপর হামলা হয় তখন। সে সময় প্রশাসন ছিল চুপ। মাননীয় উপাচার্য মহোদয় এসব কিছুকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা আখ্যা দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেন। অপরদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, তারা দু-তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ভোট দিতে পারেননি। ডাকসু নির্বাচনে এমন ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না।
এরপর যখন ফল প্রকাশ শুরু হয়, তখন নাটকের আরেক দৃশ্য। এসব ঘটনা কি প্রমাণ করে না যে, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে যে অপবাদ ও মিথ্যাচারের প্রচলন রয়েছে, সেটা ছাত্ররাজনীতিতেও জায়গা করে নিয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে যে, মেধা ও বুদ্ধির চর্চার কথা বলা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই লোপ পেয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের মতো একটা বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের সেটা হয়েছে। এই যে রাজনৈতিক দেউলিয়া ও মানসিক দীনতা, এর দায় তো প্রধান রাজনৈতিক দলের ঘাড়েই বর্তায়। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশার কথা ছিল যে, জাতীয় রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতা ও অপবাদ-মিথ্যাচারের যে রীতি চালু হয়েছে, সে অচলায়ত্ব ভাঙবে কিন্তু সেটা হলো কই? তবুও আশার দিক যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের অস্তিত্ব বুঝতে শিখেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এই ধারাবাহিকতা চলমান থাকলে সেটা আরো বাড়বে। আগামীতে এটাই দেখার বিষয়।
আমাদের শিক্ষক সমাজের নৈতিক দীনতার অবস্থান কতটা নিচুতে নেমেছে ডাকসু নির্বাচন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কারণ নির্বাচনে যে কারচুপি হয়েছে এটা মোটামুটি সবাই জানে। নির্বাচনের দিনে ছাত্রলীগ কারচুপির কথা না মানলেও এখন ঠিকই স্বীকার করে নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কারচুপির পেছনে বড় অবদান কার বা কাদের? নির্বাচন পরিচালনা তথা সার্বিক দায়িত্ব ঢাবি প্রশাসনের। তাই নির্বাচনে ঘটনা-দুর্ঘটনা যা হয়েছে সব দায়ভার ঢাবি প্রশাসনের। প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগেই ব্যালটে সিলমারা হয়েছে, ভোটদানে বাধা এসেছে, প্রার্থীদের ওপর হামলা ও লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। একমাত্র ছাত্রলীগ বাদে অন্যসব প্যানেল ভোট বর্জন করেছে। নির্বাচনের কারচুপি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। দুটি পদ বাদে আর বাকি ২৩টি পদে ছাত্রলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছে। হল সংসদের ক্ষেত্রের ১২টি হলে ছাত্রলীগ জয় পেয়েছে। কিন্তু ছাত্রী হলে ছাত্রলীগ জয় পায়নি। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ছাত্রী হলগুলোতে ছাত্রলীগের দলীয় প্রভাব না থাকার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে পেরেছে। তাহলে কি এটা স্পষ্ট নয় যে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে ফল আরো ভিন্ন হতো। নির্বাচিত ভিপি ইতোমধ্যে এই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। সবশেষে কি এটা পরিষ্কার হয় যে, ডাকসু নিয়ে যে আশা ছিল তা ঢাবি প্রশাসন পূরণ করতে পারেনি।
শত অনিয়মের মধ্যেও কিছু আশার দিক থাকে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু আছে। বড় বিষয় হলো, ক্ষমতার দাপট ও হল দখলকেন্দ্রিক যে ছাত্ররাজনীতি চলমান ছিল, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই অপরাজনীতির আঁতে ঘা লেগেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ ১০ বছর ছাত্রলীগের দাপটে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ পরমতসহিষ্ণুতার একটা দৃষ্টান্ত দেখিয়েছ। এটা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির যে সহাবস্থানের কথা বলা হয় সে ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। শত বিরোধিতা ও অপপ্রচার সত্ত্বেও নুরুল হক নুরকে ছাত্রলীগ ভিপি হিসেবে মেনে নিয়ে আগামীতে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। যেটাকে বড় আশার দিক বলা যায়। তরুণ এই নেতাদের হাত ধরেই হয়তো আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
sadikiu099@gmail.com