মো. আরাফাত রহমান
জিনা হলো অবিবাহিত দুইজন মানুষের মধ্যে যৌনক্রিয়া। ব্যুৎপত্তিগতভাবে জিনা হলো ইসলামি বৈবাহিক নিয়ম অনুযায়ী পরস্পর অবিবাহিত মুসলিমের মাঝে অবৈধ যৌন সম্পর্ক বিষয়ক একটি ইসলামি নিষেধাজ্ঞা। বিবাহোত্তর যৌনতা এবং বিবাহপূর্ব যৌনতা যেমন-পরকীয়া বা পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহিতদের অবৈবাহিক যৌন সম্পর্ক। ব্যভিচার বা দুজন অবিবাহিতের পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনসঙ্গম। পতিতাবৃত্তি বা অর্থের বিনিময়ে যৌনসঙ্গম। আর ধর্ষণ বা জোরপূর্বক অবৈবাহিক যৌনসঙ্গমের অন্তর্ভুক্ত। জিনা কবিরা গুনাহ। যা তওবা ব্যতিরেকে মাফ হয় না। কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘লা তাকরাবাল জিনা’। অর্থাৎ ‘তোমরা জিনার ধারে-কাছেও যেও না’।
কোরআনের পর ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হাদিসে জিনাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে সকল প্রকারের বিবাহবহির্ভূত যৌনসঙ্গম হিসেবে। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত সূত্রে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আদম সন্তানের ওপর জিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে তা অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে। দু-চোখের জিনা হলো নিষিদ্ধ যৌনতার প্রতি দৃষ্টিপাত করা। দু-কানের জিনা হলো শ্রবণ করা। রসনার জিনা হলো কথোপকথন করা। হাতের জিনা হলো স্পর্শ করা। পায়ের জিনা হলো হেঁটে যাওয়া। অন্তরের জিনা হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা ও কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ অবশেষে তা বাস্তবায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামে জিনা একটি শাস্তিযোগ্য পাপ এবং আল্লাহর বিরুদ্ধাচারকারী একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য। কোরআন এবং হাদিসসমূহে এটি উল্লেখিত রয়েছে। কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, যে কোনো প্রকারের যৌন ক্রিয়াকলাপ যা বৈধ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যতীত সম্পাদিত হয় সেগুলো জিনা বলে গণ্য হবে। আর তা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য সমানভাবে শাস্তিযোগ্য। কোরআনের বেশ কয়েকটি জায়গায় জিনা সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো কোরআনের সাধারণ নিয়ম যেখানে মুসলিমদের জিনায় লিপ্ত না হতে আদেশ দেওয়া হয়েছে, ‘তোমরা জিনার ধারে কাছেও যেয়ো না, কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩২)
কোরআনে সর্বপ্রথম সুরা নিসায় জিনার শাস্তি সম্পর্কিত সাময়িক অস্থায়ী নির্দেশনা অবতীর্ণ করা হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারিণী তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চারজন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে তলব করো। অতঃপর যদি তারা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে সংশ্লিষ্টদেরকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখ, যে পর্যন্ত মৃত্যু তাদেরকে তুলে না নেয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোনো পথ নির্দেশ না করেন। তোমাদের মধ্যে যে দুজন সেই ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাদেরকে শাস্তি প্রদান কর, অতঃপর তারা যদি উভয়ে তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে, তবে তাদের থেকে হাত গুটিয়ে নাও। নিশ্চই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়ালু।’ (সুরা নিসা, আয়াত- ১৫, ১৬)
কিন্তু পরবর্তীতে সুরা নূরে নবায়িত নির্দেশনা অবতীর্ণ হওয়ার পর পূর্বোক্ত আয়াতের নির্দেশনা রহিত হয়ে যায়। এছড়াও অধিকাংশ নিয়মকানুন যেগুলো জিনা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর বা সমাজের সদস্যগণ কর্তৃক সতী সাধ্বী নারীর ওপর আরোপিত অভিযোগ সম্পর্কিত, সেগুলো সুরা নূরে পাওয়া যায়। এই সুরাটি শুরু হয়েছে জিনার শাস্তি সম্পর্কিত বেশ কিছু বিশেষ নির্দিষ্ট নিয়মকানুন প্রদানের মধ্য দিয়ে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষ ও নারী যারা, তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত প্রদান করো, তাদের বিষয়ে করুণা যেন তোমাদেরকে দুর্বল না করে, এমন একটি বিষয়ে যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং মহাপ্রলয় দিবসের ওপর বিশ্বাস রাখো: এবং বিশ্বাসীদের একদলকে তাদের শাস্তির সাক্ষী করে রাখ।’ (সুরা আন-নুর, আয়াত-২) ‘এবং যারা নিরপরাধ নারীদের ওপর অভিযোগ আরোপ করে এরপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারে না, তাদের বেত্রাঘাত কর আশিটি করে এবং এরপর কখনই তাদের কাছ থেকে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করো না এবং এটি একারণে যে তারা সীমালঙ্ঘনকারী। তারা ব্যতীত যারা অনুতপ্ত হয় এবং সংশোধিত হয়, কারণ নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা আন-নুর, আয়াত-৪, ৫)
হাদিসে জিনার শাস্তির বর্ণনা এসেছে জনসম্মুখে বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড হিসেবে। এটি পাওয়া যায় মূলত হাদিসের ‘কিতাব-আল হুদুদ’ নামক সংকলিত খণ্ডাংশে। উবাদা বিন আস-সামিত বর্ণনা করেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। আল্লাহ সেসব মহিলাদের জন্য আদেশ জারি করেছেন। যখন একজন অবিবাহিত পুরুষ একজন অবিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর বিবাহিত পুরুষের সাথে বিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে হবে।’ (সহিহ মুসলিম)
ইসলামে কোনো পুরুষ বা কোনো নারীকে জিনার শাস্তি দেওয়ার জন্য বিশ্বস্ত তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত করা প্রয়োজন। এগুলো হলো-১. একজন মুসলিম কর্তৃক জিনার দোষ স্বীকার। তবে, উক্ত ব্যক্তি যে কোনো সময়ে দোষ স্বীকারকে প্রত্যাহার করার অধিকার পাবে; উক্ত ব্যক্তি যদি দোষ স্বীকার প্রত্যাহার করে, তখন ৪ জন মুসলিম পুরুষ সাক্ষী ব্যতিরেকে তাকে আর জিনার শাস্তি দেওয়া যাবে না। অথবা ২. কোনো নারী যদি গর্ভবতী হয় কিন্তু বিবাহিত না হয়, অথবা ৩. নির্ভরযোগ্য ৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম পুরুষ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য এবং তাদের প্রত্যেকেই একই সময়ে সঙ্গমরত অবস্থায় দেখে থাকতে হবে।
আরবী ভাষায়, জিনা-আল-জিবর শব্দটি ধর্ষণ অর্থে ব্যবহূত হয়। ইসলাম ধর্ষণ বা বলপূর্বক যৌন হয়রানিকে অনুমোদন করে না। এ সম্পর্কে সুনানে আবু দাউদে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়কালের একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে জনৈক মহিলা সালাত আদায়ের জন্য গমনকালে পথিমধ্যে তার সাথে একজন পুরুষের দেখা হলে, সে ব্যক্তি জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে। সে মহিলা চিৎকার দিলে, তার পাশ দিয়ে গমনকালে জনৈক ব্যক্তি এর কারণ জানতে চায়। তখন সে মহিলা বলে অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এরূপ অপকর্ম করেছে। পরে তার পাশ দিয়ে মুহাজিরদের একটি দল গমনকালে সে মহিলা তাদের বলে-অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এরূপ কাজ করেছে। তারপর তারা গিয়ে এক ব্যক্তিকে ধরে আনে, যার সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল যে, সে-ই এরূপ করেছে।
এরপর তারা সে ব্যক্তিকে উক্ত মহিলার কাছে উপস্থিত করলে, সেও বলে, হ্যাঁ। এই ব্যক্তিই এ অপকর্ম করেছে। তখন তাঁরা সে ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নিয়ে যায়। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সে ব্যক্তির ওপর শরিয়াতের নির্দেশ জারি করার মনস্থ করেন, তখন মহিলার সাথে অপকর্মকারী ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এই অপকর্ম করেছি। তখন নবী মোহাম্মদ সে মহিলাকে বলেন, তুমি চলে যাও, আল্লাহ তোমার অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন। এরপর তিনি ভুলভাবে ধরে আনা লোকটির সাথে উত্তম ব্যবহার করেন এবং ধর্ষক ব্যক্তিটির জন্য বলেন, একে পাথর মেরে হত্যা করো। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, লোকটি এমন তওবা করেছে যে, সমস্ত মদিনাবাসী এরূপ তওবা করলে, তা কবুল হতো।
হাদিসের বিবৃতি অনুযায়ী অধিকাংশ আইনবিদের বক্তব্য হলো, ধর্ষকের শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। তবে কিছু আধুনিক আইনবিদ মনে করেন, ধর্ষকের শাস্তি একজন জিনাকারীর মতোই। অর্থাৎ ধর্ষক বিবাহিত হলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং অবিবাহিত হলে তাকে একশত বেত্রাঘাত প্রদান এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন দিতে হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই শাস্তি জনসম্মুখে প্রদান করতে হবে। ধর্ষিতাকে কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়া হবে না, কারণ ধর্ষিতারা সাধারণত প্রতিরোধ ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল হয়ে থাকেন।
পতিতাবৃত্তি ইসলামে নিষিদ্ধ ও হারাম। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর শুধু পার্থিব জীবনে তোমরা কিছু স্বার্থ লাভ করার উদ্দেশ্যে তোমাদের দাসিদেরকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করো না, যদি তারা সতীত্ব বজায় রাখতে চায়।’ কোনো মুসলিম যদি এ কাজে সম্পৃক্ত হয় তবে তার শাস্তি ব্যভিচারের অনুরূপ, তা হলো অবিবাহিতের জন্য একশত বেত্রাঘাত ও একবছরের নির্বাসন এবং বিবাহিতের জন্য একশত বেত্রাঘাত ও মৃত্যুদণ্ড। পূর্বে আরবে পতিতাবৃত্তির প্রচলন ছিল। ইসলাম আগমনের পর নবী মোহাম্মদ সকল স্তরে পতিতাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বর্ণিত, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ইসলামে কোনো পতিতাবৃত্তি নেই। কেউ যদি ইসলাম-পূর্ব সময়ের পতিতাবৃত্তির চর্চা করে থাকে, তাহলে তা হতে আগত সন্তান মালিকের সম্পত্তি হবে। যে ব্যক্তি বৈধ বিয়ে বা মালিকানা ছাড়া কাউকে সন্তান দাবি করে, তার কোনো উত্তরাধিকারীও থাকবে না এবং সে কারো উত্তরাধিকারও পাবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ)
লেখক : কলামিস্ট, সহকারী কর্মকর্তা (ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ) সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়