মহামারীর আকার নিয়েছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। জীবনঘাতী এই ভাইরাস বিশ্বজুড়ে মানবদেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক উদ্ভাবিত হয়নি, উদ্ভাবিত হয়নি নিরাময়ের ওষুধও। স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকার করেছে এ বিষয়টি। এ ভাইরাসের প্রতিষেধক ও নিরাময়ের ওষুধ উদ্ভাবনে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। কবে উদ্ভাবিত হবে করোনার প্রতিষেধক এবং ওষুধ—সে অপেক্ষাতেই এখন দিন কাটছে বিশ্ববাসীর। তবে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে যে দেশটিতে সেই চীন দাবি করেছে— জাপানে তৈরি একটি ওষুধ প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছে তারা। ওষুধটির নাম ফাভিপিরাভির। এটি এভিগ্যান নামেও পরিচিত।
অন্যদিকে, আশার কথা হলো, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ামাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই এর জিনোম সিকোয়েন্স জানতে পেরেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। আর দুই মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রে আবিষ্কৃত প্রতিষেধক প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবনের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। প্রতিদিনই নতুন ওষুধ কোম্পানি, সরকারি বা আধা সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর দাতব্য সংস্থাগুলো তাদের একক বা যৌথ উদ্যোগের কথা ঘোষণা করছে।
জাপানের তৈরি ওষুধ বিষয়ে চীনের চিকিৎসা কর্মকর্তারা বলেছেন, ফাভিপিরাভির নামে জাপানের তৈরি একটি ওষুধ করোনার চিকিৎসায় ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন তারা। ওষুধটি জাপানে ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ঝ্যাং সিনমিন ১৭ মার্চ এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ফাভিপিরাভির প্রস্তুতকারক টয়ামা কেমিক্যাল। টয়ামা জাপানের বহুজাতিক কোম্পানি ফুজিফিল্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ফাভিপিরাভির একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। ওষুধটি চীনের উহান ও শেনজেন এলাকার ৩৪০ জন করোনা সংক্রমিত রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। এতে ব্যাপক ও কার্যকর সফলতা পাওয়া গেছে।
এদিকে জাপানের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে জানায়, করোনা আক্রান্ত যাদের শরীরে ফাভিপিরাভির প্রয়োগ করা হয়েছে, তারা গড়ে চার দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যেখানে অন্য রোগীরা সেরে উঠতে সময় লেগেছে ১১ দিন। এ ছাড়া রোগীদের বুকের এক্স-রের মাধ্যমে জানা গেছে, যেসব রোগীর শরীরে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের ফুসফুসের অবস্থা ৯১ শতাংশ উন্নতি হয়েছে। ফাভিপিরাভির না নেওয়া রোগীদের ওই সময়ে ফুসফুসের উন্নতি ঘটেছে ৬২ শতাংশ।
জাপানের চিকিৎসকেরাও ওষুধটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করছেন। তবে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে বলেছে, গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে ফাভিপিরাভির পুরোপুরি কার্যকর নয়। এর আগে ইবোলার সংক্রমণ মোকাবিলায় জাপান সরকার ২০১৬ সালে একই ওষুধ আফ্রিকার দেশ গিনিতে পাঠিয়েছিল জরুরি সহায়তা হিসেবে। তবে এটি করোনা চিকিৎসায় পুরোদমে ব্যবহারের জন্য সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে আগামী মে মাস নাগাদ এই অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে বলে জানায় সূত্র।
গত ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানতে পারে, চীনের উহানে অজ্ঞাত কারণে মানুষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর ১০ দিনের মাথায় ৯ জানুয়ারি চীনের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা জানায়, তাদের বিজ্ঞানীরা নতুন করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স জানতে পেরেছেন। সার্স-করোনা ভাইরাসের গোত্রেরই ভাইরাস এটি। এর দুই মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো করোনার প্রতিষেধক পরীক্ষামূলকভাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
এর আগে চীনে ২০০২ সালে দেখা দেওয়া সার্স-করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স জানার পর এটি প্রতিরোধে প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছিল ২০ মাস। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের শুরুটা হয়েছিল ২০১৫ সালে। আর প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে সময় লেগেছিল ছয় মাস।
এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রিয়াসুস গত বুধবার বলেন, টিকার কার্যকারিতা যাচাইয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। চীন এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ফলাফল জানানোর ৬০ দিনের মাথায় এটা করা সম্ভব হলো। এটাকে ‘দারুণ অগ্রগতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি।
বিবিসি ও সিএনএনের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে গত সোমবার ৪৩ বছর বয়সী এক নারীর দেহে পরীক্ষামূলকভাবে করোনার প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়েছে। ওই নারী ছাড়া আরো তিনজনের শরীরে প্রতিষেধকটি প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রতিষেধকটির উদ্ভাবক মার্কিন জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মডার্না থেরাপেটিকস। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আর্থিক সহযোগিতায় এখন এই প্রতিষেধকের পরীক্ষা চলছে। এটি পরীক্ষার প্রথম ধাপ। এরপর আরও কয়েক ধাপে সফল পরীক্ষার পর প্রতিষেধকটি সবার ব্যবহারের জন্য নিরাপদ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
এদিকে মডার্না ছাড়াও আরো ৩৫টি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে জানায় গার্ডিয়ান। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সার্স-করোনা ভাইরাসের সঙ্গে নতুন করোনা ভাইরাসটির জন্মগত বৈশিষ্ট্যে মিল রয়েছে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ।
তবে প্রতিষেধক উদ্ভাবিত হলেই যে সংক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করা যাবে, তা ঠিক নয়—এমনটাই মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জনাথন কুইক। তিনি বলেন, সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রতিষেধক গুরুত্বপূর্ণ একটি অগ্রগতি। তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো জনসাধারণ পর্যন্ত প্রতিষেধক পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, করোনা সংক্রমণের বিদ্যমান মহামারী রুখতে উল্লিখিত দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে ওষুধের নানা পরীক্ষা চলছে বিভিন্ন দেশে। এ রোগের ৪০টির বেশি ওষুধ পরীক্ষার নানা পর্যায়ে রয়েছে। অ্যান্টিভাইরাল অর্থাৎ, আক্রান্ত লোকজনের চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ দরকার মানবদেহে সেগুলোর পরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। বেশ কয়েকটির ফলাফলও আসতে শুরু করেছে। আর প্রতিরোধী ভ্যাকসিন পেতে অপেক্ষা করতে হতে পারে ছয় মাস থেকে এক বছর।





