মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান
হজরত হুসাইন (রা.) হলেন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র এবং সম্মানিত ইমাম। তার আম্মাজান হলেন হজরত ফাতিমাতুজ জোহরা আর আব্বাজান হলেন হজরত আলী মর্তুজা। বড় ভাই হলেন হজরত হাসান (রা.)। পবিত্র কোরআনে যাদেরকে ‘আহলে বাইত’ বলা হয়েছে; হজরত হুসাইন (রা.) তাদের মধ্যে অন্যতম। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কেবল চান যে, হে আহলে বায়াত! তোমাদের থেকে সকল নাপাকি দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পূত পবিত্র করতে।’ (সুরা আহযাব, আযাত-২৩) উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন এমন অবস্থায় প্রত্যুষে বের হলেন যে, তার শরীর মোবারক নকশা বিশিষ্ট চাদর দ্বারা আবৃত ছিল। তখন হজরত হাসান (রা.) আসলে নবীজি তাকে নিজের চাদরের মধ্যে শামিল করে নিলেন। এরপর ইমাম হুসাইন (রা.) আসলে তাকেও নবীজি চাদরে জড়িয়ে নিলেন। অতঃপর হজরত ফাতেমা (রা.) আসলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে চাদরের মধ্যে শামিল করে নিলেন। সর্বশেষে হজরত আলী (রা.) এলে তাকে চাদরের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতঃপর পবিত্র কোরআন কারিমের সুরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াত তেলাওয়াত করেন। (মুসলিম, হাদিস নং-২৪২৪)
হজরত হুসাইন (রা.) সাথে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘনিষ্ঠতা এমনভাবে ছিল যেন উভয়ই এক ও অভিন্ন সত্তা। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন হজরত হাসান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বক্ষ হতে মাথা পর্যন্ত অংশের সাথে সাদৃশ্য ছিল আর হোসাইন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীর মোবারকের অবশিষ্ট নিচের অংশের সাথে সাদৃশ্য ছিল। (তিরমিযি, হাদিস নং-৩৭৭৯, মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-৭৭৪, ৫৭৭৯)
হজরত হুসাইন (রা.) চতুর্থ হিজরির ৩ শাবান মদিনা শরিফে জন্মগ্রহণ করেন। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাকে অত্যধিক ভালোবাসতেন। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের সময় তার বয়স ছিল ছয় বছর। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা হাসান ও হোসাইনের হাত ধরে বললেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে ও এই দুইজনকে ভালোবাসল এবং এদের পিতা ও মাতাকে ভালোবাসল সে কেয়ামত দিবসে আমার সাথে থাকবে।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-৩৭৩৩)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত হুসাইন (রা.) কে অকৃত্রিম ভালোবাসার মাত্রা সম্পর্কে নিচের হাদিসটি থেকে উপলব্ধি করা যায়। একদিন হজরত হুসাইন (রা.) গলির মধ্যে খেলছিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি লোকদের সামনে এগিয়ে গিয়ে তার দুই হাত প্রসারিত করে বাড়িয়ে দিলেন। বালকটি এদিক-ওদিক ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হাসতে হাসতে ধরে ফেলেন। এরপর তিনি এক হাতে ছেলেটির চোয়ালের নিচে রাখলেন, আর অন্য হাত তার মাথার ওপর রাখলেন। তিনি তাকে চুমু দিলেন এবং বললেন, হোসাইন আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে। যে হোসাইনকে ভালোবাসবে আল্লাহতায়ালা তাকে ভালোবাসবে। হুসাইন আমার নাতিদের একজন (তিরমিযি, খণ্ড-২, হাদিস নং-১৭১০, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৪৪) প্রকৃতপক্ষে হুসাইন (রা.) হলেন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র। আর তারই অংশ এটা যৌক্তিক। কিন্তু প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী ‘আমি হোসাইন থেকে’ এটা কিভাবে সম্ভব?
এর ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, এখানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝাতে চেয়েছেন হজরত হুসাইন (রা.) এর বাহ্যিক এবং যতগুলো সৌন্দর্য-মাধুর্য রয়েছে তার সবকিছুই প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম থেকে প্রাপ্ত। আর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাহ্যিক প্রকাশ ঘটেছে হজরত হুসাইন (রা.)-এর মাধ্যমে। খাইবার যুদ্ধ যেখানে যয়নাব বিনতে হারেসা নামক মহিলা প্রিয় নবীজির জন্য বিষ মাখানো গোস্ত পরিবেশন করলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক টুকরা মুখে নেওয়ার সাথে সাথে ফেলে দেন। তৎক্ষণাৎ তা প্রিয় নবীজিকে কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। অনুরূপভাবে ওহুদের যুদ্ধে দাঁত মোবারক শহিদ হওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্য শাহাদাতের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আর তা পূর্ণতা লাভ করেছিল কারবালার ময়দানে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মাধ্যমে। ৬১ হিজরিতে ১০ মহররম কারবালার ময়দানে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এজিদ বাহিনীর সাথে অসম যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন। সাথে নবী পরিবারের সদস্যগণসহ প্রায় ৭২ জন পুণ্যাত্মা ব্যক্তিও শাহাদতের সুধা পান করেন।
অপর হাদিসে রয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হজরত আব্বাস (রা.) এর স্ত্রী হজরত উম্মুল ফজল (রা.) এক রাতে একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে তিনি স্বপ্নের কথা বললেন। হে আল্লাহর রাসুল! আমি স্বপ্নে দেখলাম আপনার পবিত্র শরীর মোবারক থেকে এক টুকরো মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে আমার কোলে এসে পড়ল। এই ধরনের ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে আমি অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়েছি। স্বপ্ন শুনে নবীজি মুচকি হেসে বললেন, ‘আপনি ভালো স্বপ্ন দেখেছেন। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ইনশাআল্লাহ কয়েকদিন পরেই আমার ফাতিমার ঘরে একটা পুত্র সন্তান জন্ম নেবে আর সেই সন্তানকে সর্বপ্রথম আপনার কোলেই দেওয়া হবে।’ কয়েকদিন পরে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর জন্ম হলে সর্বপ্রথম হজরত উম্মুল ফজল (রা.)-এর কাছে দেওয়া হয়। (মিশকাত,পৃ-৫৭২)
দুনিয়াতে মানুষ ফুলকে খুব পছন্দ করে। ফুল সুগন্ধ ছড়ায়। যেখানেই ফুল থাকে সেই স্থানটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত হাসান এবং হোসাইনকে সুগন্ধময় ফুলের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, হাসান এবং হোসাইন দুইজন এই পৃথিবীতে আমার দুইটি সুগন্ধ ফুল। (তিরমিযি, হাদিস নং-৩৭৭০) অপর হাদিসে রয়েছে, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (রা.)কে বেহেস্তবাসী যুবকদের সর্দার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হজরত হুযাইফা (রা.) বর্ণনা করেন, আমার মাতা আমার কাছে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি বললাম কয়েকদিন হতে আমি প্রিয় নবীজির দরবারে হাজির হতে পারিনি। এতে আমার মা অসন্তুষ্ট হলেন। আমি বললাম, মা আমাকে অনুমতি দিন আমি এখনই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে তার সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করব। আর আমার ও আমার মায়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়ার অনুরোধ করব। অতঃপর আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলাম এবং তার সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। এমনকি শেষ পর্যন্ত এশার নামাজও আদায় করলাম। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাওনা করলে আমি পেছনে পেছনে চলতে লাগলাম। তিনি আমার আওয়াজ শুনে বললেন কে, হুজাইফা নাকি? আমি আরজ করলাম জি, হ্যাঁ । তিনি বললেন তোমার কি প্রয়োজন রয়েছে? আল্লাহতায়ালা তোমাকে ও তোমার মাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতঃপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই একজন ফেরেশতা যে ইতোপূর্বে কখনো পৃথিবীতে আগমন করেননি। ফেরেস্তাটি প্রভুর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেছে যেন সে আমার উপরে সালাম পেশ করে এবং আমাকে সুসংবাদ দেয় যে, ফাতেমা হলেন জান্নাতি মহিলাদের সরদার এবং হাসান ও হোসাইন হলো জান্নাতি যুবকদের সর্দার। (তিরমিযি, হাদিস নং- ২/১৭১৬, মুসনাদে আহমদ)
হজরত আব্দুল্লাহ বিন সাদ্দাদ তার পিতা শাদ্দাদ (রা.) হতে বর্ণনা করেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা এশার নামাজ আদায়ের জন্য আমাদের নিকট তশরিফ আনলেন। তিনি হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.) এর মধ্যে কোন একজনকে কাঁধে করে এনেছিলেন। নবীজি তাকে জমিনে বসিয়ে দেন অতঃপর নামাজের জন্য তাকবির বললে নামাজ পড়া শুরু করে দিলেন। নামাজের মধ্যে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম সিজদা দীর্ঘায়িত করলেন । হজরত শাদ্দাদ বলেন আমি মাথা তুলে দেখলাম সিজদা অবস্থায় নবীজির মাথা মোবারকের ওপর তার শাহজাদা আরোহণ করছে। আমি পুনরায় সিজদায় চলে গেলাম। যখন নামাজ সম্পন্ন করলেন তখন লোকেরা আরজ করলেন, আপনি নামাজের মধ্যে সিজদাকে এত দীর্ঘ করেছেন অথচ আমরা মনে করেছি আল্লাহর কোনো নির্দেশ হয়ত বাস্তবায়ন হয়ে গিয়েছে কিংবা আপনার ওপর ওহি নাজিল হচ্ছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন এমন কিছু নয়। তবে কারণ হলো আমার ওপরে আমার সন্তান আরোহণ করেছিল এজন্য তাড়াতাড়ি করাটা আমি পছন্দ করিনি, যতক্ষণ না তার মনের চাহিদা পূর্ণ হয়নি। (নাসায়ি, হাদিস নং-১১৪১, আল মুসতাদরাক -১/১৬৬)
প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবা এবং খোলাফায়ে রাশেদিনগণও হজরত হাসান-হুসাইন (রা.) কে ভালোবাসতেন। হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেন, আমি হাসান ও হোসাইন (রা.) উভয়কে নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এরশাদ মোবারকের কাঁধে ওপর আরোহী দেখে বললাম আপনাদের নিচে কতইনা উত্তম সওয়ারি! এটি শুনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটাও তো দেখবে যে আরোহীরাওতো কতই উত্তম! (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ- ৯/১৮১)
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল