নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার গঠনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নতুন চারটি নির্বাচন নিয়ে নতুন ভাবনার মুখোমুখি হয়েছে। এসব নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় অনেকটা ‘বেকায়দায়’ পড়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনগুলোকে তুলনামুলক বিতর্কমুক্ত, দলীয় কোন্দল নিয়ন্ত্রণ, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, ভোটের মাঠে সব দলের সহাবস্থান ও ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ লক্ষ্যে দলের নীতিনির্ধারকদের নানা কৌশল নির্ধারণেও ভাবতে হচ্ছে।আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় বিএনপি। ফলে তুলনামূলক কম বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন দলটির জন্য এখন চ্যালেঞ্জ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপনির্বাচন, সারা দেশের বিভিন্ন উপজেলা পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) নির্বাচনে বিএনপি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতৃত্বের সমস্যা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে অংশ নিচ্ছে না, এমন প্রচারণা আওয়ামী লীগের নেতারা চালিয়ে যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিএনপির দুর্বলতাগুলো সত্য হলেও আসন্ন নির্বাচনগুলোতে ভোটের মাঠের পরিবেশ যত সুন্দর ও সুষ্ঠু হবে, আওয়ামী লীগেরও ওই প্রচারণাও ততটা ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
সূত্র জানায়, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া ও না-পাওয়াকে কেন্দ্র করে দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে কি না, এমন উদ্বেগও আছে দলের শীর্ষপর্যায়ের কয়েক নেতার। বিশেষ করে আসন্ন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো অবস্থাতেই যেন দলীয় কোন্দলের প্রকাশ না ঘটে, সেদিকে দলকে শুরু থেকেই বিশেষ সতর্ক থাকতে হচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে আওয়ামী লীগের টিকেটে সহজেই জয়ী হওয়া সম্ভব বলে অনেকে মনে করতে পারেন। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিক দলের নেতাদেরই তখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা ও দলের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা করছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
প্রথমবারের মতো এবার উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের সময় ঘটা আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দলকে সমালোচনার কবলে পড়তে হয় ভেতরে ও বাইরে। এর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য এবার আগেভাগেই দল সতর্ক। শীর্ষপর্যায়ের কোনো কোনো নেতার এ নিয়ে উদ্বেগও আছে।
অন্যদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে উপজেলা চেয়ারম্যানদের। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যানও সংসদ নির্বাচনে দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিরোধ মাঠেও গড়ায়। উপজেলা চেয়ারম্যানরা সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন না বলে দলের শীর্ষপর্যায় থেকেও সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। তবু অনেক জেলা ও উপজেলায় বিরোধ থামেনি।
গত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনের তুলনায় এবার স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে বিরোধ ছিল চরমে। সদ্য শেষ হওয়া সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধের কারণে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে যেন খেসারত দিতে না হয়, সেসব দিক নিয়েও ভাবতে হচ্ছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে।
সূত্র জানায়, আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল- এ তিন মাস ভোটের চ্যালেঞ্জে থাকবে আওয়ামী লীগ। দেশ ও বিদেশে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে যেন বিতর্কের সৃষ্টি না হয়, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দল হিসেবে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আসন্ন নির্বাচনগুলোর সময় ইসিকেও সহায়তা করবে আওয়ামী লীগ ও এর রাজনৈতিক মিত্ররা।
পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপিকে নির্বাচনের জন্য মাঠে ‘ছাড়’ দেবেও আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের মাঠে ঐক্যফ্রন্টকেও চায় ক্ষমতাসীন দলটি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচনের মতো এবারের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোও বিএনপির অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ চায় আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে মাঠে রাখতে প্রয়োজনে ‘রাজনৈতিকভাবে ছাড়’ দিতেও আওয়ামী লীগের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে বলে জানায় দলটির উচ্চপর্যায়ের সূত্র।
দলের শীর্ষ নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগের প্রথম চ্যালেঞ্জ ডিএনসিসির উপনির্বাচন। এখানে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত হলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত আছেন, এমন অনেকেই প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসির মেয়র পদে ভোট নেওয়ার দিন ঠিক করেছে ইসি। ডাকসুর নির্বাচন আরেক রকম চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের জন্য। দীর্ঘ ২৮ বছর পর এ নির্বাচন হচ্ছে আগামী ১১ মার্চ। ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো দাবি তুলছে সহাবস্থান ও সবার সমান সুযোগ নিশ্চিতের। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগ বরাবরই দাবি করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সব ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান রয়েছে।
মার্চ মাসে কয়েক ধাপে হবে উপজেলা নির্বাচন। সারা দেশের মোট ৪৯৩টি উপজেলায় ভোট নেওয়ার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হবে। এ জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে সারা দেশের জেলা ও উপজেলার অনেক নেতা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জের আরেক অংশ হবে ময়মনসিংহ সিটির ভোট। আগামী ১৩ এপ্রিলের মধ্যে মসিকের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আছে। স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী, কোনো এলাকাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণার ১৮০ দিনের মধ্যে ওয়ার্ডগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে সেখানে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়।
অন্যদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘পরাজয় ও তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে’ বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে ভোটের পর বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। দলের সিদ্ধন্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে কেউ কোথাও প্রার্থী হলে তাকে বহিষ্কার করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়। দলের এমন সিদ্ধান্তের পরও উপজেলা পরিষদসহ মসিকের নির্বাচনে দলটির অনেক নেতা শেষ পর্যন্ত অংশ নেবে বলেও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।