বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে দুটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। কোনো নির্দিষ্ট এলাকার ৩০-৪০ বছরের আবহাওয়ার গড় হলো জলবায়ু। জলবায়ুর উপাদানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর চাপ, মেঘ, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি। কোনো কারণে যদি জলবায়ুর উপাদানগুলোর স্থায়ী পরিবর্তন হয়, তখনই জলবায়ু পরিবর্তন হতে শুরু করে।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের জন্য হুমকি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যেতে পারে পুরো বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র, যা ক্রমেই উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। তাই প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী এবং গবেষণা প্রতিবেদন কী বলছে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে যে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণকে বোঝানো হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (সিআরআই) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় প্রথমেই অবস্থান করছে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ। এই সমীক্ষাটি ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৩টি দেশের ওপর চালানো হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠান প্রকাশিত ২০০৭ ও ২০০৮ সালের রিপোর্টেও বাংলাদেশকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রের পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকরা বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে পোস্টার চাইল্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলাদেশ একটি ক্রম উন্নয়নশীল দেশ। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য আমাদের নিজেদের রিসোর্স ব্যবহার করতে হবে। নিজেদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতেই এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার সর্বোত্তম উপায় হতে পারে সবুজ আন্দোলন। সহজভাবে বললে সবুজ আন্দোলন বলতে বোঝায় সারা বাংলাদেশকে সবুজে রূপান্তরিত করার জন্য বৃক্ষরোপণ করা। এই আন্দোলনের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘গ্রিন মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বৃক্ষরোপণের চেয়ে আর কোনো সহজ ও সর্বোত্তম উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজেদেরই উদ্যোগী হতে হবে। সবার মধ্যে সবুজ আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। সবুজ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সুপরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রয়োজনে জাতীয়ভাবে অধিদফতর কিংবা বিশেষায়িত সংস্থা গঠন করা যেতে পারে, যার কাজ হবে সারা দেশে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তোলা। দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সবুজ আন্দোলনে অর্থাৎ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সমাজ। শিক্ষার্থীরা যেমন খুব সহজেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝতে পারে, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় তাদের হাতেকলমে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি, কোনো কোনো দেশের মোট জনসংখ্যাও এত নয়, এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীকে যদি সবুজ আন্দোলনে যুক্ত করে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা যায়, তাহলে প্রত্যেক শিক্ষার্থী যদি একটি করেও বৃক্ষ রোপণ করে, তাহলে মোট ৩ কোটি বৃক্ষ রোপণ করা হবে। আর যদি প্রতি বছর ২টি করে বৃক্ষরোপণ করে, তাহলে এক বছরে মোট ৬ কোটি বৃক্ষ রোপণ করা হবে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬ কোটি বৃক্ষ রোপণ করা হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশ সবুজে ভরে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তলিয়ে যাবে না দেশের নিম্নাঞ্চল। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু সবুজ আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়া সহজ বিষয় নয়। সরকারি সহযোগিতা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে শুরুটা করা যেতে পারে বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিয়ে। দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় কোটি। এই দেড় কোটি শিশু শিক্ষার্থীকে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রত্যেককে একটি করে গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহিত করা হবে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিশু শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই দিনে বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন করা যেতে পারে।
শহরের শিক্ষার্থীদের বাসার ছাদে কিংবা টবে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করতে হবে। শিশুরা যেমন আনন্দ পাবে তেমনি তাদের মাঝে পরিবেশ সচেতনতা বাড়বে। এরপর দেশব্যাপী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫ লাখ। প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে টিম গঠন করা যেতে পারে। এই টিমগুলোর কাজ হবে নির্দিষ্ট দিনে সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা, বৃক্ষরোপণে এলাকাবাসীকে উৎসাহিত করা। নিজ নিজ এলাকায় বৃক্ষরোপণ উৎসব পালন করা। বছরের নির্দিষ্ট দিনে নিজেরা বৃক্ষরোপণ করা। মাধ্যমিক স্তরের প্রতিটি শিক্ষার্থী যদি প্রতি বছর একটি করে বৃক্ষরোপণ করে তাহলে তাদের রোপিত বৃক্ষের সংখ্যা হবে বছরে ৭৫ লাখ। ফলে দেশের বনভূমির পরিমাণ বাড়বে। সবুজে ভরে উঠবে সমগ্র দেশ।
কোনো দেশে বছরে ৭৫ লাখ বৃক্ষ রোপণ করলে সেই দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা যেহেতু উদ্যমী ও চঞ্চল, তাই এদের সহজে গ্রিন মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ’ বা সবুজ আন্দোলনে যুক্ত করা যেতে পারে। ফলে একই সঙ্গে তাদের সহশিক্ষা কার্যক্রমও সম্পন্ন হবে। তবে এই সবুজ আন্দোলন তখনই ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, যখন পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে। পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এই আন্দোলন একবার ছড়িয়ে পড়লে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে এটি হবে বাংলাদেশের যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
লেখক : প্রাবন্ধিক