সম্পাদকীয়

গ্রামে কেন করোনা কম

  • প্রকাশিত ৮ নভেম্বর, ২০২০

শেখ আনোয়ার

 

 

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে আসতে শুরু করেছে। মৃত্যুর হারও কম। এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। শঙ্কা না কাটলেও করোনায় চিরায়ত বাঙালির কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক ব্যবহার ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে করোনার লাগাম টানার চেষ্টা চলছে।

করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর থেকে একটি বিষয় লক্ষ করা যায়। সেটি হলো শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ সংক্রমিত কম। সংক্রমিত হলেও বেশির ভাগ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে, এর মূল কারণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় গ্রামের মানুষ শহরের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামের মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটাই কার্যকর যে ভাইরাস শরীরকে সম্পূর্ণ কব্জা করার আগেই সেটিকে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়। তথ্য মতে, মানুষের শরীরে যখন কোনো রোগজীবাণু বাসা বাধে, তখন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। দেখা যায়, রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সহজাতভাবেই সাড়া দেয়। ফলে সহজে অসুখ-বিসুখকে তারা জয় করেন। রোগজীবাণু ঠেকানোর প্রক্রিয়ায় গ্রাম ও শহরের মানুষের শরীরে আপাতত খুব একটা তফাত না থাকলেও, এ ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষের শরীর নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ছিল ঢাকা শহরে। পরে যুক্ত হয় নারায়ণগঞ্জ শহরের নাম। এরপর মানুষকে ঘরে রাখার উদ্দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলেও অমান্য করে মানুষ। দল বেঁধে ঢাকা থেকে গ্রাম-গঞ্জে চলে যায়। তারপর একে একে ৬৪ জেলাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ছাড়া করোনায় বেশি প্রকোপ দেখা যায় চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগের শহরাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চল কিংবা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, নগরায়ণের মাত্রা যেখানে বেশি, সেসব এলাকায় সংক্রমণের প্রভাব বেশি।

গবেষকরা জানান, উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে করোনার অপেক্ষাকৃত কম সংক্রমণ ঘটেছে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমিত ৪ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ লাখ। আফ্রিকা মহাদেশে মোট সংক্রমণের সংখ্যা মাত্র ২৩ হাজার। যে দেশ যতো উন্নত, যে সমস্ত দেশে শিল্পাঞ্চল, শহরাঞ্চল বেশি, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যখাতে যে দেশের ব্যয় যত বেশি, সেই সমস্ত দেশেই করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বেশি। মৃত্যুর হারও অধিক। আধুনিক শিল্পশহর চীনের ওহান করোনার আঁতুড়ঘর। ওদিকে চীনের গ্রামাঞ্চলে করোনার খুব একটা দেখা নেই। চীন থেকে করোনা উদ্ভূত বলা হলেও প্রশ্ন ওঠে, ইউরোপ বা আমেরিকার অনেক উন্নত ও অতিরিক্ত আধুনিক শহরের দেশগুলোর বিপুল সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত কেন? মৃত্যুর সংখ্যা কেনই বা লাগামহীন? তুলনায় কম উন্নত দেশগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেক কম কেন? দুটো ভাগের দেশের মধ্যে এই পার্থক্যই বা কেন? তাহলে শহরাঞ্চলের আদর্শিক মাত্রার সঙ্গে করোনা সংক্রমণের কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে কি? ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক জন কেটস বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোপন মূল্য মানুষ দিতে শুরু করেছে মাত্র। অভিশাপ পূর্বপুরুষের।’

মহামারীর অতীতের পাতার ওপর চোখ বুলালে দেখা যায়, সাধারণ প্লেগ, গুটিবসন্ত, কলেরা, ম্যালেরিয়া, অ্যানসেফ্যালাইটিস, টাইফয়েড, পোলিও, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম এমন অসংক্রামক রোগে সংক্রমিত বা মৃত্যুর সংখ্যা সব সময় সর্বাধিক হয়ে থাকে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। ব্যতিক্রম স্প্যানিশ ফ্লু। যাতে উন্নত ইউরোপের দেশগুলোতে আক্রান্ত অনেক বেশি ছিলো। সেসব রাষ্ট্রের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে মানুষের গড় আয়ু অনেক কম। শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি। এই সমস্ত দেশে এমন এমন রোগে এখনো বহু মানুষের মৃত্যু হয়, যার অনেক ওষুধ রয়েছে। চিকিৎসাও রয়েছে। এই সমস্ত রোগের চিকিৎসার ব্যয়ও খুব বেশি নয়। ইউরোপ বা আমেরিকা মহাদেশের অনেক উন্নত দেশ স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু যত অর্থ ব্যয় করে, তার তুলনায় এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা তথা দক্ষিণ গোলার্ধের উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় অনেক কম। আবার এমনও দেখা যায়, উন্নয়শীল দেশগুলোর শহর এলাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা চিকিৎসার যতটা উন্নত সুবিধা রয়েছে, গ্রামাঞ্চলে তা নেই। এইচআইভি জাতীয় রোগ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা বিভিন্ন উন্নত দেশ যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে, তার এক ভগ্নাংশ অর্থ খরচ করতে পারলে ডায়েরিয়া, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া জাতীয় অসুখ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বের কয়েক লাখ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো হয়তো সম্ভব হতো।

এমন অবস্থায় গবেষকদের সামনে এসেছে নতুন আলোচনা। ‘শহরকে শুধুমাত্র বাজারের দৃষ্টিতে না দেখে এর সামাজিক, মানবিক ও দীর্ঘ স্থায়িত্বের প্রসঙ্গ।’ সামনে আসছে প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখে ভারসাম্যমূলক উন্নয়নের ভাবনাও। পুঁজিবাদী পশ্চিমা দুনিয়ার উন্নয়ন ও শহরায়নকে অন্ধভাবে অনুসরণ করার বিষয়টাও প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। গবেষকরা বলেন, ‘অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ নিজস্ব ঐতিহ্যকে স্মরণে না রেখে, দেশের আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ না করে, শুধু জোর দিচ্ছে উন্নয়নের গতির ওপর।’ এ মুহূর্তে সবচাইতে বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এখন অভিযুক্ত। এই গতি বৃদ্ধি করতেই চলছে প্রাকৃতিক সম্পদের নির্বিচার ব্যবহার ও লুট। এতে অবহেলিত হচ্ছে পরিবেশ। ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, গ্রাম ও সামাজিক দীর্ঘ স্থায়িত্ব। এই গতি বৃদ্ধির একটি তথ্য হলো, ১৯৭১ সালে বিশ্বে ৩০ কোটি মানুষ বিমানে ভ্রমণ করেছিলো। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৪৫০ কোটি। উন্নত দেশগুলোর এই অতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন, ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস বদল, জীবনযাত্রার পদ্ধতির পরিবর্তন, ভূমি বা ভূপৃষ্ঠের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানি ও শক্তি নির্ভরতা প্রকৃতি ও পরিবেশকে করে তুলছে অসুরক্ষিত। পরিবেশ বিজ্ঞানীরাও বলেন, ‘বন্য জীবজগতে মানুষের অপরিণামদর্শী দখলদারির জন্য অন্য প্রজাতির শরীরস্থিত অণুজীবরা ক্রমশ লাফিয়ে মানব প্রজাতির উপর আশ্রয় করছে। ফলে অভিযোজিত ও অভিব্যক্তিজনিত নিত্যনতুন ভাইরাসকে প্রতিহত করতে পারছে না মানবসমাজ। বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংখ্যা ও মাত্রা। করোনা হয়তো তেমন এক রোগের নাম। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে যার বেশি প্রভাব পড়েছে শহরাঞ্চলের মানুষের দেহে।’

একবিংশ শতাব্দী বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উন্নয়ন, আধুনিক শহর সভ্যতার শতক। এই সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে। এরপরও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতের সুবিধা কম। করোনায় মৃত্যুহারও কম। ওদিকে উন্নত দেশে স্বাস্থ্য খাতে সুবিধা বেশি হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে দেখা যায়, করোনার মতো বহু রোগ শহরকেন্দ্রিক। পুঁজিবাদী কাঠামোতে এই শহর এখন করোনা মহামারীর সামনে বেসামাল। গবেষকরা বলেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ নগরায়ণের ফলশ্রুতিতে করোনাভাইরাস উন্নত দেশগুলোর শহরাঞ্চলে বেশি। এর আসল কারণ নিহিত রয়েছে নগরায়ণ প্রক্রিয়ার অপরিণামদর্শী পদ্ধতিগত ত্রুটির মধ্যে।’ তাই স্বাস্থ্যসুবিধা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি, শহরাঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটি-বিচ্যুতি শুধরে নেওয়ার উদ্যোগ আগামী দিনের স্বার্থে বর্তমান সময়ে অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, শহর বর্তমান শতকের অনিবার্য প্রক্রিয়া। এর থেকে পালানোর পথ নেই। তাই সার্বিক অংশগ্রহণমূলক, বিকেন্দ্রীকৃত, পরিবেশবান্ধব উপাদানের সমন্বয়ে শহর তৈরি প্রক্রিয়া, যা শুধু বাজারতাড়িত, লোভ ও লাভের একচ্ছত্র আধিপত্য দ্বারা নির্ধারিত হবে না, এমন ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনার এখন আদর্শ সময় বৈকি!

পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সবচেয়ে দ্রুত ও বেশি হারে শহর সভ্যতা গড়ে উঠছে। শিল্প বিপ্লবের কারণে গ্রামাঞ্চলে দ্রুত গতিতে নতুন নতুন শিল্পস্থাপনা সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামীণ অবকাঠামোর ভেতরে ঢুকে পড়েছে শহরাঞ্চলের ছোঁয়া। শহরের চৌহদ্দী প্রসারিত হচ্ছে। শহরগুলোও অনেকাংশেই অপরিকল্পিত এবং বাজার অভিমুখী। সরকারি স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার কারণে এসব শহরে গড়ে উঠেছে মুনাফাকেন্দ্রিক মানহীন বেদরকারি বা বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বর্তমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে আমাদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের প্রয়োজনে শিল্প। শিল্পের প্রয়োজনে মানুষ নয়। মানুষের জীবনমান অক্ষুণ্ন রেখে শিল্পকে ঢেলে সাজালে মানবসভ্যতা টিকে থাকবে। শিল্পের কারণে মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে গেলে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যের জন্য শহরের পরিকল্পিত আধুনিকায়ন প্রয়োজন। শহরে কিংবা গ্রামে অপরিকল্পিতভাবে একটি বাড়িও যেনো নির্মাণ করা না হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় গ্রামের নির্দিষ্ট স্থানে সুন্দর নিরাপদ বাসস্থান গড়ে উঠুক। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়গুলো স্থাপিত হোক। সেজন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের চেয়ে সদিচ্ছা বেশি জরুরি। করোনা-উত্তর বাংলাদেশ হয়ে উঠুক সত্যিকার উন্নত, বিশ্বের অন্যতম রোল মডেল।

 

লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads