মতামত

গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম

  • মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  • প্রকাশিত ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের নাম মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। গান্ধীর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল সত্য ও অহিংসা। তিনি রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক ও ধর্মীয় যে কোনো সমস্যা বা সংঘাত মানুষকে অহিংস উপায়ে সমাধানের শিক্ষা দিয়েছেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করে। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর ভারতের পোর বন্দরের হিন্দু ‘মোধ’ সম্প্রদায়ে গান্ধীর জন্ম। গান্ধীর বাবা করম চাঁদ তার ছেলে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীকে বাল্যকালে ‘কস্তুরী বাঈ’ নামে এক অনিন্দ্যসুন্দরী বালিকার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন গান্ধীর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।

গান্ধীর পিতামহ উত্তম চাঁদ গান্ধী ছিলেন তৎকালীন পোর বন্দর রানার প্রধানমন্ত্রী। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীর বাবা মারা গেলে তার খুড়ো তুলসী দাস গান্ধী পোর বন্দর রানার প্রধানমন্ত্রী হন। গান্ধী পরিবার বংশানুক্রমে রানার প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ করে আসছিলেন। হাইস্কুলের পড়া শেষ হলে গান্ধীকে তার খুড়ো বিলাত পাঠাতে নারাজ হন। কারণ সেখানে সাহেবদের সংস্পর্শে এলে গান্ধীর জাত যাবে। কিন্তু গান্ধী নাছোড়বান্দা। তার বন্ধুদের অনুরোধে বিলাত গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য জিদ ধরলেন। তিনি ছিলেন ‘মধুবেনিয়া হিন্দু’। মধুবেনিয়া সম্প্রদায় গান্ধীর বিলাত যেতে বাধা দিল। বিলাত গেলে তাকে আর তারা সমাজে নেবেন না বলে ভয় দেখান। গান্ধী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ স্টিমারের টিকেট কিনে আনলেন।

মা পুতলী বাঈর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন গান্ধী। ছোট ছেলে এত দূরদেশে যাবে, সেখানে গেলে তার জাত থাকবে না, সেজন্য মা-ও বিলাত যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেন। গান্ধী তখন জৈন সম্প্রদায়ের এক ধর্মপ্রাণ সন্ন্যাসীকে তার মায়ের সামনে নিয়ে এলেন। সন্ন্যাসীর নাম ছিল বিচারজী স্বামী। বিচারজী স্বামী গান্ধীকে তার মায়ের সামনে শপথবাক্য পাঠ করালেন যে, গান্ধী বিলাতে গিয়ে মাছ, মাংস, মদ কিংবা কোনো নারীকে স্পর্শ করবে না। এভাবে জননীর মন জয় করে মহাত্মা গান্ধী ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাতে যাত্রা করলেন। বিলাত যাত্রার কয়েক মাস আগে গান্ধীকে তার স্ত্রী কস্তুরী বাঈ একটি পুত্রসন্তান উপহার দিলেন। সন্তানটির নাম রাখা হয়েছিল ‘হরিলাল’। বিলাত পৌঁছে গান্ধী তার মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তিনি বিলাতে কখনো ডিম, মাংস, পুডিং, কেক স্পর্শ করেননি। বিলাতে ছাত্রাবস্থায় হোস্টেলে নিজ হাতে নিরামিষ রান্না করে খেতেন। অবসর সময়ে ভগবত-গীতা পাঠ করতেন। তরুণ বয়স থেকেই তিনি নিজেকে মহৎ ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পাস করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। গান্ধী যখন বাড়ি ফিরে আসেন, তখন তাঁর শিশুপুত্র হরিলালের বয়স ছিল মাত্র চার বছর।

গান্ধীজির খুড়োর মৃত্যু হলে গান্ধীর বড় ভাই লক্ষ্মী দাস গান্ধী পোর বন্দর রানা স্টেটের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মহাত্মা গান্ধী অত্যন্ত সাধাসিদে পোশাকে থাকতে ভালোবাসতেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ বছর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করে একজন কৃতবিদ্য রাজনীতিজ্ঞ আর স্বনামধন্য আইনজীবীর গৌরব অর্জন করেছিলেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর গান্ধীজির দ্বিতীয় পুত্র মণিলাল জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে নিজ বাড়িতে ফিরে স্ত্রী-পুত্রসহ দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে গেলেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তার তৃতীয় পুত্র রামদাস গান্ধী এবং ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তার চতুর্থ পুত্র দেবদাস গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল প্রদেশেই জন্মগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি তার স্ত্রী-পুত্রদের শিক্ষা দিয়েছিলেন অস্পৃশ্যতা বর্জন করতে। গান্ধীজি তার সেই মেজাজ সবসময় বশে রাখার সাধনা করতে লাগলেন। এই সাধনা তাকে পরবর্তী যুগে ‘অহিংসযোগী’ আখ্যায় অভিনন্দিত করেছিল। তখন থেকেই গান্ধীজি সবসময় আলাদা বিছানায় ঘুমাতেন। কস্তুরী বাঈ কখনো তার বিখ্যাত স্বামীর চিন্তা ও সাধনায় বাধ সাধতেন না। প্রকৃতপক্ষে উভয়েই জৈবিক আর যৌন চিন্তা পরিহার করে মানবিক আর ভগবত চিন্তায় আত্মসমর্পণ করলেন।

তখন থেকে গান্ধীজি আফ্রিকার গ্রামে গ্রামে অস্পৃশ্যতার আন্দোলন গড়ে তোলেন। গান্ধীজি ১৯০৬ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ সাঁইত্রিশ বছর বয়স থেকে আমৃত্যু নিষ্কাম ধর্ম পালন করেন। আফ্রিকায় থাকতেই মহাত্মা গান্ধী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ‘সত্যাগ্রহ’ শব্দের অর্থ হলো সত্যকে গ্রহণ করে প্রেম আর শক্তির উৎস সন্ধানে ব্যাপৃত থাকা। আত্মাকে পুড়িয়ে শুচিশুদ্ধ করা।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি ভারতে অসহযোগ আন্দোলন করে জেলে গেলেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি গান্ধীজি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য অনশন শুরু করলেন। পরে তিনি দেশের নেতাদের অনুরোধে অনশন ভঙ্গ করতে স্বীকার করলেন একটি শর্তে। শর্ত হলো- অনশন ত্যাগ করার আগে প্রথমে কোরআন, পরে বাইবেল, তারপর গীতা পাঠ করে তাকে শোনাতে হবে। তার শিষ্যদেরও শুনতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে এই অনশন উৎসব উদযাপিত হলো। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ভারতের জেলখানাগুলো ‘সত্যাগ্রহী’ কয়েদিতে ভরে গেল। অবিভক্ত বাংলার যেসব নেতা অসহযোগ আন্দোলনে কারাবরণ করেন, তাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ চন্দ্র বসু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা আকরম খাঁ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, মওলানা মুজিবর রহমান, পীর বাদশা মিয়া, নবাব ওয়াজেদ আলী খান, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়, কিরণ শংকর রায়, মৌলভী তমিজউদ্দীন খাঁ, আবুল হোসেন সরকার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

গান্ধী কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে জমিদারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এ বিক্ষোভ চলাকালেই জনগণ গান্ধীকে ভারতবর্ষের ‘বাপু’ ও ‘মহাত্মা’ উপাধি দেন। গান্ধী ছিলেন বহুমুখী লেখক ও সম্পাদক। এক দশকে তিনি সম্পাদনা করেছেন গুজরাট, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা ‘হরিজন’।

তার নিজের পরিধেয় কাপড় ছিল ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ধুতি এবং শাল, যা তিনি নিজেই চরকায় বুনতেন। তিনি সাধারণত নিরামিষ খাবার খেতেন। আত্মশুদ্ধি ও প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য উপবাস থাকতেন।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নয়াদিল্লির বিড়লা ভবনের মধ্যে এক রাতের পথসভায় নাথুরাম গডসে নামক এক হিন্দু মৌলবাদী তাকে গুলি করে হত্যা করে।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads