ফারজানা বীথি
শত প্রতিকূলতায়ও আপন আলোয় নিজেকে বিকশিত করছে নারী। রক্ষণশীল সমাজে চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে, নানা প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন তারা। ক্রীড়াঙ্গনে সাম্প্রতিক সাফল্য এর প্রমাণ। সবাইকে অবাক করে একটার পর একটা সাফল্যগাথা রচনা করে চলেছেন আমাদের দেশের অদম্য নারী ক্রীড়াবিদরা। খেলার মাঠে তাদের হাতে ধরা লাল-সবুজের পতাকা এখন অনন্য উচ্চতায়। তাদের হাতেই রচিত হচ্ছে আমাদের সমৃদ্ধ ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস। বিশ্ববাসী নতুন করে যেন চিনে নিচ্ছে বাংলাদেশকে। একসময় ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের মতো খেলাগুলো ছিল পুরুষদের একচ্ছত্র দখলে। নারীরা ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামবে এটি এখনো অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কিন্তু এই ট্যাবু দিন দিন ভেঙে দিচ্ছে নারীরাই। খেলাধুলার অধিকাংশ ক্ষেত্র এখন নারীর পদচারণায় মুখর। শুধু কি তা-ই? প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তাদের সাফল্যের গল্পও। এই তো মাসখানেক আগের কথা, এশিয়ার পরাশক্তি ভারতকে ফাইনালে ৩ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে জিতে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। টানা পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে তারা। ক্রিকেটে বাঙালি নারীদের উত্থানের গল্পটি হঠাৎ করে নয়, বরং এই পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৮২ সালে। আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে ১৯৮৩ সালে দলনেতা আইভির নেতৃত্বাধীন দলটি ইডেন গার্ডেনসে পশ্চিমবাংলা নারী ক্রিকেট দলের বিপক্ষে ৩০ ওভারের একটি প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেয়। যদিও পরবর্তী সময়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও এই খেলায় মেয়েদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়নি তেমন। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বাংলাদেশি নারীরা এরপর থেকেই যেন ভালো করে চিনতে শুরু করেছে ক্রিকেটের ব্যাট-বলকে। ২০০৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে মাত্র ৯ রানে অল আউট করে ১০ উইকেটের বিশাল জয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ নারী দলের পথচলা। এর পরের সবকিছুই যেন গল্প। বার বার সফলতা এসেছে সালমাদের হাত ধরে। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত অনেক মেয়েই আজ খেলাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
ফুটবলে বাংলাদেশি নারীদের সাফল্যের গল্পটি আরো বিস্ময়কর। ২০১৫ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ দলের টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরে একদল কিশোরী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের নিয়ে শুরু হয় হৈচৈ। দেশের প্রত্যন্ত কালসিন্দুরের মতো এলাকায় বেড়ে উঠেছে এই কিশোরী দলটি। এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে সমাজের নানা জনের নানা কথাকে পেছনে ফেলে তাদের বিস্ময়কর সাফল্যের গল্পটি সিনেমাকেও হার মানায়। তারা এখন সারা দেশের নারীদের কাছে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ফাইনালে ১-০ গোলে হারায় ভারতকে। চ্যাম্পিয়ন ট্রফির পাশাপাশি ফেয়ার প্লে ট্রফিও পায় বাংলাদেশ। সে বছর এই টুর্নামেন্টের ৭ ম্যাচে মেয়েরা মোট গোল করে ২৮টি। সে আসরে ফাইনালের আগেই লিগ ম্যাচে নেপাল, ভুটান ও ভারতকে যথাক্রমে ৬-০, ৩-০ ও ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে নিভে যাওয়া ফুটবল উন্মাদনার শেষ সলতেটি যেন তারাই জ্বালিয়ে দিয়েছে আবার। শোনা যাচ্ছে, আমাদের মেয়েরাও নাকি ক্লাব পর্যায়ে ফুটবল খেলতে যাচ্ছে অন্য দেশে। সম্প্রতি জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের স্ট্রাইকার সাবিনা ক্লাব ফুটবলে হ্যাটট্রিক করে জানান দিয়েছেন বাঙালি নারীদের সামর্থ্যের কথা। শুধু ফুটবল আর ক্রিকেটে নয়, গর্ব করার মতো আমাদের আরও অনেক নারী ক্রীড়াবিদ রয়েছেন, যারা দেশের জন্য বিরল সন্মাননা বয়ে এনেছেন। টেবিল টেনিসের বিস্ময়, বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ জোবেরা রহমান লিনু। ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে যিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম উঠিয়েছেন। সাঁতারেও পিছিয়ে নেই মেয়েরা। এসএ গেমসে দুটি সোনা জিতে সাড়া ফেলেছেন মাহফুজা আক্তার শিলা। নৌবাহিনীর এই সাঁতারু ১০০ ও ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে জিতে নেন এ সোনা। বুদ্ধির খেলা দাবায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার শামীমা আক্তার লিজা। তিনি বাংলাদেশ মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০৫, ২০১০ ও ২০১৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হন। এছাড়া তিনি প্রথম বাংলাদেশি মহিলা দাবাড়ু হিসেবে বিশ্ব মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় অ্যাথলেটিকসের ৪০তম আসরের দ্রুততম মানবী হয়েছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শিরিন। তিনি টানা চারবারের মতো দেশসেরা দ্রুততম মানবী হয়েছেন। ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশি নারীদের জয়যাত্রায় এসব নারী পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন।