আব্দুল হাই রঞ্জু
বলা যায়, তিন বছর আগে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কৃষি জমি বাড়ছে না, অথচ মানুষ বাড়ছে। এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি আহ্বান জানান, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি গবেষণা বাড়াতে হবে। তিনি আরো বলেন, কৃষি গবেষণা বাড়ানো যেমন জরুরি, তেমনি পরিকল্পিত শিল্পায়নও করতে হবে। যেন দুই তিনফসলি জমিতে কোনোভাবেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বরং একফসলি জমিতে শিল্পসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। তা হলে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বলয়কে মজবুত করা সম্ভব হবে। মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা বলয়কে মজবুত করা কঠিন হবে না মর্মেও তিনি মন্তব্য করেন।
বাস্তবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে উচ্চ ফলনশীল জাতের খাদ্য শস্য উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে মাত্র ৭ কোটি মানুষের খাদ্য সংকট ছিল তীব্র। আমদানিনির্ভর খাদ্যশস্যের ওপর খাদ্যের জোগানই ছিল একমাত্র অবলম্বন। একমাত্র সেচভিত্তিক বোরো চাষের বদৌলতে সে সংকট অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। পানিই আমাদের ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদ। যে পানির ওপর ভর করে স্বাধীনতা উত্তর গত ৪৬ বছরে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণেরও বেশি। ফলে ৭ কোটি জনসংখ্যার স্থলে আজ প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আগাম বন্যা, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, অতি শীতের প্রকোপ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এসব অভিঘাত মোকাবিলা করে এদেশের চাষিরা খাদ্য উৎপাদন করেই যাচ্ছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সরকারের যুগোপযোগী সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এদেশের চাষিদের কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়। অনেক সময় বাড়তি ফলনের কারণে ক্ষেতেই সবজি নষ্ট করতে কৃষক বাধ্য হয়। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চাষিরা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে সবজি চাষে সফলতা অর্জন করেছে। এজন্য উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে সমন্বিত কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তাহলে চাষিরা কৃষিপণ্য উৎপাদন করে সঠিক সময়ে স্বল্প খরচে হিমাগারে সংরক্ষিত করতে পারলে কৃষক যেমন একদিকে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন, অন্যদিকে দেশীয় চাহিদা পূরণের পর বাড়তি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভবপর হবে। কৃষি অর্থনীতিনির্ভর দেশ হওয়ার পরও স্বাধীনতা-উত্তর ৪৬টি বছরে কৃষকের স্বার্থরক্ষায় কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে স্থাপিত হয়নি। আবার ব্যক্তি উদ্যোগে বেসরকারিভাবে যেসব কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে, তাও সরকারি প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। ফলে বহুজাতিক অনেক কোম্পানির গর্ভে কৃষিনির্ভর শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠা চালকল শিল্প বিলীন হয়ে গেছে। শুধু চালকল শিল্পই নয়, ঐতিহ্যে লালিত চিনি শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। আখের উপযুক্ত মূল্যের অভাবে আখচাষিরা আখ চাষ করা ছেড়েই দিয়েছে। যদিও সরকার দেশীয় আখকল শিল্পের উন্নয়নে চিনিকলগুলোতে উৎপাদন চালু রাখার চেষ্টা করছে। সেখানেও বিপত্তি হচ্ছে, বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানির সুযোগ দেওয়ায় হাতে গোনা কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চিনি বিপণন পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে দেশীয় চিনিকলে উৎপাদিত চিনি ক্রেতার অভাবে মিলেই নষ্ট হচ্ছে। এমনকি চিনিকলগুলো প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছে। আর বিদেশিদের দেশে উৎপাদিত অপরিশোধিত চিনির একচেটিয়া বাজারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ, যা ঘটছে আমাদের ভ্রান্ত কৃষি নীতিমালার কারণে। দেশের সাধারণ ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকার যে কোনো পণ্য আমদানি কিংবা রপ্তানি করে থাকে। পণ্যের বাড়তি উৎপাদন হলে উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষায় সে পণ্য বিদেশে রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার কোনো পণ্যের সংকট দেখা দিলে ভোক্তার স্বার্থে সে পণ্য আমদানিও করতে হয়। পাঠক, একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, আমাদের যে ক’টি চিনিকল রয়েছে, তা ঠিকঠাক মতো চালু রাখা সম্ভব হলে দেশীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। অথচ বিভিন্ন সময়ে দেশীয় শিল্প বন্ধ হওয়ার মতো পরিকল্পনা গ্রহণ করার মাধ্যমে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে দেশীয় চিনি শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের বেকার মানুষের কর্মসংস্থান যেমন হচ্ছে না, তেমনি চিনিকলে কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিক বেতন ভাতার অভাবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।
এর মূলেই রয়েছে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার বিষয়টি। কারণ একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় গুটিকতক মানুষের হাতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। তা না হলে হাতে গোনা ৭/৮টি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় কী করে? এসব বহুজাতিক কোম্পানির মালিকরা খেয়াল খুশিমতো চিনির দর নির্ধারণ করায় অনেক সময়ই প্রতি কেজিতে ৭/৮ টাকা পর্যন্ত বেশি দরে ভোক্তাদের চিনি কিনে খেতে হয়। এটাই এক ধরনের পরোক্ষ শোষণ প্রক্রিয়া। ফলে স্বাধীনতা-উত্তর এদেশের প্রকৃত চাষিরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কর্মসংস্থানের দ্বারাও প্রসারিত না হয়ে বরং সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গুটিকতক মানুষের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে অপরিশোধিত চিনি আমদানির মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তির চিনিকলের প্রসার দেশীয়ভাবে ঘটাতে হবে, তাহলে আখের চাষও বাড়বে এবং আখচাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তা না করলে চাষিদের স্বার্থের কথা বলতে বলতে হয়তো ক্ষমতাসীনরা মুখে ফেনা তুলতে পারবে সত্য, কিন্তু প্রকৃত অর্থে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এসবের কারণে শুধু আখচাষিদেরই স্বার্থই ক্ষুণ্ন হয়নি, ক্ষুণ্ন হচ্ছে ভুট্টাচাষি ও আলুচাষিদের স্বার্থও।
যেমন চরাঞ্চলের দোআঁশ মাটিতে স্বল্প পানিতে ভুট্টা ও আলুচাষে চাষিরা ঈর্ষণীয় সফলতা এনেছে। ভুট্টা একটি পোলট্রি শিল্পে মুরগির অন্যতম খাবার। সম্ভাবনাময় এ খাতটির উন্নয়নে স্বল্পমূল্যে মুরগির খাদ্যের সংস্থান হলে একদিকে যেমন পোলট্রি শিল্পের সমৃদ্ধি আসবে, অন্যদিকে চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষ করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। অপ্রিয় হলেও সত্য, ভুট্টাচাষিরা ভুট্টার ন্যায্যমূল্যের অভাবে এখন ভুট্টার চাষ কমিয়ে দিয়েছে। ‘হূদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে দুই বছর আগে নীলফামারীতে এসে অর্থমন্ত্রী ভুট্টাচাষিদের দাবির মুখে ওয়াদা করেছিলেন, ভুট্টাচাষিদের ভুট্টার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ধান, চাল, গমের মতো সরকার অভ্যন্তরীণভাবে ভুট্টাও সংগ্রহ করবে। বাস্তবে দুটি বছর অতিবাহিত হলেও অর্থমন্ত্রীর ওয়াদা অপূরণই থেকে গেছে। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা জনস্বার্থে ওয়াদা করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা পূরণ হয় না।
পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক খাদ্যশস্যের বহুমুখী চাষাবাদকে আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। আর এজন্য কৃষি গবেষণা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের খাদ্যশস্যের উদ্ভাবনকে নিশ্চিত করতে হবে। আজ দেশ ৫০ বছর অতিক্রম করতে চলেছে। আমরাও বলছি যে, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু তারপরও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে বাংলার কৃষকদের অনেক প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে এগোতে হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সরকারের উচিত হবে ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যশস্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবেই আমরা ২০২১-৪১ রূপকল্প ছুঁতে পারব। তা নাহলে যে হারে মানুষ বাড়ছে, তাদের খাদ্যের জোগান দেওয়া কঠিন হবে। সে কথাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ অনুষ্ঠানে তিন বছর আগেই জোর দিয়ে বলেছেন। আমরাও মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এ তাগিদ যথার্থই যা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র সংশ্লিষ্টজনরা নিশ্চিত করবেন।
লেখক : সমাজকর্মী