বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

কয়লার বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

বায়ুদূষণ রোধসহ নানা সমস্যা সমাধানে কয়লার বদলে এলএনজি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চায় সরকার। তবে এলএনজির সংস্থান কঠিন হওয়ার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন বলেন, আমরা পরিবেশে বায়ুদূষণের কথা বিবেচনা করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছি। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা তো আছেই, তাই বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে। পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানের আওতায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, কয়লার পরিবর্তে এলএনজির কথা যেমন ভাবা হচ্ছে, তেমনই গ্যাস সংকট এবং দামের কথাও আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে। অপরদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে জমি এবং বিনিয়োগ বড় সমস্যা, সেগুলোও বিবেচনা করতে হবে।

এরই অংশ হিসেবে কাজ শুরু না হওয়া ১৩টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ইতমধ্যে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সরকার দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার শুরুতেই কয়লার ওপরে জোর দেয়। এজন্য দেশের মোট বিদ্যুতের ৫০ ভাগ কয়লা থেকে উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন মহাপরিকল্পনা ২০১০’ পরবর্তী সময়ে সংশোধন করে কয়লা থেকে ৩৫ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এখন রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ী প্রকল্পের বাইরে আর কোনও বিদ্যুৎকেন্দ্রেই জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হবে না। ফলে ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কী ধরনের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার হবে, সে বিষয়ে এখনই চিন্তাভাবনা করছে সরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বিকল্প জ্বালানি হিসেবে মূলত এলএনজি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে চিন্তা করা হচ্ছে। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে অন্তত ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— বিপুল পরিমাণ জমির সংস্থান। অপরদিকে এলএনজি আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এলএনজির দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে সরকার।

এর আগে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, ২০৪১ নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তির প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের মতো। কিন্তু ২০৪০ সাল নাগাদ অন্তত ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে বিশাল এই চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যলেঞ্জ বলে মনে করেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বছর দুয়েক আগে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে গেলে কয়লাভিত্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসার যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়ন হবে না। পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকারের এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া।

 ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা বর্জন : সরকারি উদ্যোগ ও কতিপয় সুপারিশ’ শীর্ষক ওই ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ অভিমত দেওয়া হয়। এ সময় সিপিডির মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এসে বিকল্প পদ্ধতি নেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গেছে।

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২২টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে ২৩ হাজার ২৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল। এগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এগুলোতে নতুন করে বিনিয়োগে যাওয়া হবে না, এটি সরকারের অভ্যন্তরীণ অবস্থান। এরকম একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে আমরা বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই।

‘সরকারের পুরো ব্যাপারটিকে সাধুবাদ জানাতে পারতাম, যদি কয়লা থেকে এটিকে পূর্ণভাবে ক্লিন এনার্জি যেটাকে আমরা বলি নবায়নযাগ্য জ্বালানিতে যাওয়ার ব্যাপারে নীতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো’ বলেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, আমরা জানতে পারছি ভেতরে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে। এ জায়গাটাতে আমাদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। আপত্তি থাকার কারণ এর ফলে সরকারের পরিবেশ দূষণ থেকে সরে আসা অথবা ক্লিন এনার্জিতে যাওয়ার যে নীতিগত অবস্থান, সেটি এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় না। সুতরাং সরকারের এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় কয়লার বদলে কীভাবে সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া যায়।

তিনি আরো বলেন, আমরা বিজ্ঞানী নই, তারপরও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি এলএনজির পরিবেশ দূষণের মাত্রা প্রায় কয়লার সমান। সুতরাং এটাকে পরিবেশ দূষণমুক্ত ভাবার সুযোগ নেই।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রত্যাশিত বেসরকারি বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগের সহায়ক সরকারি যেসব বিনিয়োগ যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা সৃষ্টি হবে, সেটিও সময় ধরে শেষ করা যাচ্ছে না। সেটিও একটি বিষয়।

তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সরকারের নীতি অবস্থানকে গুরুত্ব দেন। যখন তারা দেখতে পান সরকারের মাস্টারপ্ল্যানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রাধিকারের জায়গায় নেই, ওরকম একটি নীতিকাঠামোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কখনো উচ্চবিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে আসার বিষয়ে আগ্রহ দেখেন না।

কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে এলে ইতোমধ্যে এ খাতে যে বিনিয়োগ হয়েছে তা অপব্যবহার হবে কি-না? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রকল্পগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। অনেকগুলোতে জমি উন্নয়নের কাজ হয়েছে। আমরা মনে করি জমির উন্নয়ন হয়ে গেলে সেখানে খুব সহজে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কাজ করা যায়।

এর আগে কয়লাভিক্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মুন্সীগঞ্জের ৫২২ মেগাওয়াটের প্রকল্প, ঢাকার ২৮২ মেগাওয়াটের প্রকল্প, চট্টগ্রামের ২৮২ মেগাওয়াটের প্রকল্প, মহেশখালীর এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের প্রকল্প, আশুগঞ্জের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের প্রকল্প, গাইবান্ধার এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের প্রকল্প, সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশের ৭০০ মেগাওয়াটের যৌথ প্রকল্প, সিপিজিসিএল-সুমিতমো করপোরেশনের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের যৌথ প্রকল্প ও বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের যৌথ প্রকল্প বাতিল করে সরকার।

পরিবেশ রক্ষায় ইতোমধ্যেই এসব কয়লাভিক্তিক ১০ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়লাভিক্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার দিকে সরকার ঝুঁকছে বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads