প্রায় দুই দশক পর আবারো আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরছে ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভিযানে ক্ষমতাচ্যুত তালেবানরা। গত কয়েকদিনে একের পর এক শহর তালেবানের দখলে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের অংশ হিসেবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। এরপর তালেবানের সশস্ত্র অভিযানের মুখে পদত্যাগ না করেই দেশ ছাড়েন গানি। খবর বিবিসি ও রয়টার্সের। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আফগানিস্তান ছেড়ে তিনি প্রতিবেশী তাজিকিস্তানের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন।
তোলো নিউজ জানিয়েছে, রোববার তালেবান যোদ্ধারা রাজধানী কাবুলে ঢোকার পর প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশত্যাগ করেন। এসময় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার কয়েকজন ঘনিষ্ট উপদেষ্টা ও সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও চলে গেছেন। এর আগে দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিসমিল্লাহ মোহাম্মদী বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশের চলমান সংকট নিরসনে ক্ষমতা দেশের রাজনৈতিক নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
মোহাম্মদী বলেন, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি প্রতিনিধি দল সোমবার (আজ) দোহা যাবে। ওই প্রতিনিধিদলে ইউনুস কানুনি, আহমদ ওয়ালী মাসউদ ও মোহাম্মদ মহাকিকসহ সরকারের অন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা রয়েছেন।
আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীগুলোকে হটিয়ে ঝড়ের বেগে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গতকাল রোববার বিনা বাধায় রাজধানী কাবুলে ঢুকে পড়ে তালেবান যোদ্ধারা। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি আমেরিকা ও ন্যাটোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন। এরপরই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরে রাজি হয় আফগান সরকার। তালেবানও দাবি করে তারা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা পরিবর্তনের পক্ষে। এরপরই শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন প্রধান হিসেবে জার্মানিতে নিযুক্ত দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত আলী আহমদ জালালির নাম শোনা যায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তালেবান প্রতিনিধিরা। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে অনুষ্ঠিত ৪৫ মিনিটের বৈঠকে নেতৃত্ব দেন তালেবান প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বরাদর। কাতার এবং আমেরিকার কূটনীতিবিদরাও সেখানে ছিলেন।
এক বার্তায় দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আফগান জনগণের চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, শহরে কোনো হামলা হবে না। অস্থায়ী সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
তালেবানের মুখপাত্র সোহাইল শাহিন বলেন, দরকষাকষি চলছে। খেয়াল রাখা হচ্ছে সাধারণ মানুষ যেন হিংসার বলি না হন। তালেবানদের কাবুলের বাইরে অবস্থান নিতে বলা হয়েছিল। তারা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে আফগান সরকারের সহযোগিতার অপেক্ষা করছিল।
এর আগে এক টুইটে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর মুখপাত্র জানান, যারা এর আগে ‘আগ্রাসনবাদীদের’ জন্য কাজ করেছেন বা তাদের সাহায্য করেছেন অথবা এখন যারা ‘দুর্নীতিবাজ’ কাবুল প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত-আইইএ (ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান) তাদের সবার জন্য দরজা খোলা রেখেছে এবং এরই মধ্যে ক্ষমা ঘোষণা করেছে। আমরা তাদের আরেকবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, যেন তারা দেশ ও জাতির সেবায় কাজ করতে এগিয়ে আসেন।
চলতি বছরের ৯ মার্চ আফগানিস্তান থেকে সেনাসদস্যদের সরিয়ে নিতে শুরু করে আমেরিকা। এরপরই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে তালেবান বাহিনী। জুন মাসের শেষ দিকে আফগান বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে তাদের। এরপরই দেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এগুতে শুরু করে তারা। বলা যায়, দেড় মাসের মধ্যেই আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে তারা।
এই পরিস্থিতিতে আফগানের রাজধানী কাবুলে বাড়ে উদ্বেগ। তালেবানের হামলার আশঙ্কায় শহরজুড়ে সৃষ্টি হয় আতঙ্কের। গতকাল ভোরে পূর্বাঞ্চলীয় নানগারহার প্রদেশের রাজধানী শহর জালালাবাদ দখলে নেয় সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধারা। দেশটির পঞ্চম বৃহত্তম এই শহরটি রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র ৮০ মাইল পূর্বে অবস্থিত।
শনিবার চতুর্থ বৃহত্তম আফগান শহর মাজার-ই-শরিফ দখলে নেয় তালেবান। মাজার-ই-শরিফ ঐতিহ্যগতভাবেই তালেবানবিরোধী শহর হিসেবে পরিচিত। বিদেশি সেনাদের প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার মধ্যে দ্রুতগতিতে শহরটি দখলে নেওয়াকে তালেবানের বড় বিজয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে আফগানিস্তানের ৩৪ প্রদেশের ২৮টি নিজেদের দখলে আনে তালেবানরা।
রাষ্ট্রক্ষমতায় তালেবান আসার খবরে সেখানকার নারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ নারীদের জন্য এর অর্থ কী হতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি।
১৯৯৬ থেকে ২০০২ সালে তালেবানরা যখন আফগানিস্তান শাসন করে তখন তালেবানপ্রণীত শরিয়া আইনে ব্যভিচারের জন্য পাথর মারা, চুরির জন্য অঙ্গ কেটে ফেলা ও ১২ বছরের বেশি বয়সি মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
এই উদ্বেগের মধ্যে তালেবানের মুখপাত্র বলেছেন, নারীদের একা বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে এবং তারা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখতে পারবেন।
উল্লেখ্য, তালেবানের আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৪ সালে, আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারের আশপাশে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়া তথাকথিত ‘মুজাহিদিন’ যোদ্ধাদের অনেককে আকৃষ্ট করেছিল।
গঠিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যেই তালেবান রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল; ১৯৯৬ সালে তারা নিজেদের দখলকৃত অংশে ‘ইসলামী আমিরাত’ ঘোষণা করে, চালু করে কট্টর শরিয়া আইন। অন্যান্য মুজাহিদিন দলগুলো পিছু হটে দেশের উত্তরাঞ্চলে চলে যায়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পর নভেম্বরে উত্তরে থাকা ওই বাহিনীগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক বিমান হামলার সহায়তা নিয়ে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তালেবান যোদ্ধারা আশ্রয় নেয় আফগানিস্তানের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায়, শুরু করে আফগান সরকার ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে ২০ বছরের দীর্ঘ লড়াই।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরও গা-ঢাকা দেন। তার আস্তানা কোথায় কিংবা তিনি কোথায় অবস্থান করছেন, তা এতটাই গোপন ছিল যে, ২০১৩ সালে তার মৃত্যু হয়েছিল এই খবরও জানা যায় দুই বছর পর। তার ছেলেই বাবার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিলেন।