কোয়ারেন্টাইনে পুরুষদের সময় কাটছে গৃহস্থালির কাজে, যে কাজের স্বীকৃতি মিলেনি আজো

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

কোয়ারেন্টাইনে পুরুষদের সময় কাটছে গৃহস্থালির কাজে, যে কাজের স্বীকৃতি মিলেনি আজো

  • সাহিদা সাম্য লীনা
  • প্রকাশিত ৭ মে, ২০২০

মহামারি করোনা ভাইরাস এমন একটা সময়ে এসেছে যখন ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে নারী-পুরষ অনেকটা সমতার কাতারে। এখন অনেক নারী ঘরের বাইরে কাজ করছেন। স্মার্ট একটা আয় করছেন। কোন নারীই বসে নেই। ৮০ % নারী এখন কর্মজীবি!

তবে এই কর্মজীবি আমরা কখন বলি নারীদের ? যখন বাইরে কাজ করে তখন? কেন? কাজ তো কাজই? তা ঘরের হোক! বা বাইরের!

নারী ঘরেও কর্মজীবি। কথা হচ্ছে, ঘরের কাজকে আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়নি আজো। দেয়া হয়নি আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি। সমতার বৈষম্যটা এখন অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে এসেছে। তবে আবদ্ব চার দেয়ালের শ্রমকে এখনো আদিম যুগে রেখে দেয়া হয়েছে।

যুগ যুগ ধরে অবহেলিত হয়ে এসেছে নিজ পরিবার, সংসারের কর্মটা। সংসারের ঘানি টানতে টানতে অনেক নারী তিলে, তিলে শেষ হয়েছেন। রোগাক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু কেউ বোঝেননি যে এই কাজটি বাইরের কাজের চাইতে তিনগুণ দামী।

মাহামারি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সরকারি আদেশে গত ২৬ মার্চ হতে দেশে সব অফিস আদালত ছুটির আওতায় এনে সবাইকে ঘরের থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, স্বাস্থ্য বিভাগ, গণমাধ্যমকর্মী এবং ব্যাংকার কে বাইরে যেতে হচ্ছে। অফিস করতে হচ্ছে। পেশানুসারে।

কিন্তু অন্য সকল পেশার মানুষকে বাসায় থাকতে হচ্ছে। এখানে আছেন ৯৮ ভাগ পুরুষ। যাদের কখনো ঘরে এভাবে থাকার ঘটনা বা সুযোগ আগে হয় নি। ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকার অভ্যাস পুরুষদের আদতে নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিত নারীরাই সাধারণত ঘরে বেশী থাকে এবং থাকতে পারে। আর তারা সেভাবে বেড়েও ওঠে।

কিন্তু করোনা মোকাবেলায় নিজের, পরিবার, প্রতিবেশীর সুরক্ষায় বাসাবাড়িতে অবস্থান নিতে হচ্ছে সকলকে। সে নারী হোক বা পুরুষ।

যেসব পুরুষকে আদৌ কখনো দিনের বেলায়, রাতের নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত বাসায় থাকতে হয় নি অথচ এখন এক রকম বাধ্য। শরীর মন একেবারে ক্লান্ত তাদের। সময় যেন একেবারেই কাটেনা। কী করবেন! কতক্ষণ টিভি দেখে ইন্টারনেট ব্যবহার করে কাটানো যায়! বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অনেক কাজে নিজেকে এখনো অভ্যস্থও করতে পারেনি। মানে বাসায় থেকে কাজ করা যায়, এমন ভাবনা।

স্ত্রীকে সহযোগিতা, বাচ্চা লালন-পালন, সাংসারিক সব কাজকে তারা মনে করে যে, এসব মেয়েলী কাজ। করোনার বেকার সময়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে প্রচুর ফান পোষ্ট ও ভিডিও তৈরি হচ্ছে।

করোনা ভাইরাসে পুরুষরা এই প্রথম বিপাকে পড়েন। সময় কাটে না তাই ঘরের কাজে তারা আআত্মনিয়োগ করেছেন।রান্নাসহ ঘর ঝাড়, মোছা সবই করছেন । ভিন্ন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে এই দুই মাসে পুরুষদের। ঘরের কাজ যে বাইরের কাজ থেকে কম কষ্টের না তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন অনেক পুরুষ।

যারা বিয়ে করে নি তারা তাদের মা বোনের সাথে ঘরের কাজে সহযোগিতা করছেন।

করোনায় কেমন কাটছে দিন এ নিয়ে বেশ কয়েকজন নানা পেশার পুরুষ তাদের মতামত জানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এখন পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেক পাল্টে গেছে।

এ নিয়ে ডেন্টিস্ট ফখরুল হাসান বলেন, 'এই সময়টাতে স্ত্রী কে সহযোগিতা করা আমি মনে করি সকল স্বামীদের দায়িত্ব, যেহেতু এখন সুযোগ আছে, আমি তো কাজ করতে পারলে আনন্দিত হই। রান্নাটা পারি না তাই করা হয় না, বাকি সব সাংসারিক কাজে আমার স্ত্রী কে সহযোগিতা করতে আমার ভালোই লাগে।’

তরুণ সংবাদকর্মী তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, 'চিরাচরিত অভ্যাস আমি নিজ থেকেই করি। তবে এবার একটু বেশি করছি যেহেতু বাহিরে কাজের চাপ কম।'

আইনজীবী সহকারী মো.ইকবাল হোসেন লিটন বলেন, ‘সংসার জীবন যাপনে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করাই উচিৎ। আমি যখনই সময় সুযোগ পাই মা-বাবা, বোন এবং স্ত্রীকে সংসারের কাজে সহযোগিতা করি । আর এখন লকডাউনে সে সুযোগটা বেড়ে গেছে।’

পুরুষের ঘরে কাজ করা নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসাহাসি বা ট্রল করছে।

এব্যাপারে ব্যবসায়ী মিরু হোসেন এসবের বিরুদ্ধে বলেন, 'এখানে জোর করে কিছুই হচ্ছেনা। নিজ থেকেই করা হচ্ছে। আমরা বরং একে অপরের পরিপূরক। নিজের সংসারের কাজ। ভাগাভাগি করলে সমস্যা কোথায়?’

নারীর ঘরের কাজের এখনো মূল্যায়ন ঘটেনি। এখনো জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ঘরোয়া কাজগুলো। অথচ এই ঘরের কাজগুলোর আর্থিক মূল্য অনেক বেশী।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেও গৃহস্থালির কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটা সূচকের কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি নানাভাবে বারবার আলোচনায় এসেছে এ বিষয়টি। এই ঘরের কাজের স্বীকৃতি থাকলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে আমরা আরও এগিয়ে যাব।

বাংলাদেশে নারীদের ঘরের কাজের আনুমানিক মূল্য আড়াই লাখ কোটি টাকা। গবেষকরা মনে করেন, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। সেই হিসাবে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে দিতে নারীর এই স্বীকৃতি প্রয়োজন।

চাঁদগাজী কলেজের বাংলার প্রভাষক মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘নারীর সম্মান ও ক্ষমতায়নের জন্য নারীর ঘরের কাজের মূল্য নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ৮ ঘন্টার মতো কাজ করে।কিন্তু এতো কাজ করার পরেও তাদের মূল্যায়ন নেই। পুরুষদের উচিৎ নারীদের এই কাজে সহযোগিতা করা। নারীর কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হলে সমাজ বুঝতে পারবে বাসাবাড়িতে নারীদের কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং মুল্য কতো। তাহলে নারীর প্রতি সমাজ শ্রদ্ধাশীল হবে।'

যদি দামী হোটেল, রেস্তোরায় কুক, বয়রা বেতন পান রান্না ও সার্ভ করে তাহলে ঘরে রান্না করে নারীরা পাবে না কেন? বলা হয় নিজের ঘরে কিসের টাকা? কে দিবে? নিজের সংসারে কাজ করে বেতন পাবে এ যেন কৌতুক।

না, এটি ছোট-খাটো বিষয় নয়। ঘরে আয়া-বুয়া রাখলে তাকেও বেতনের বিনিময়ে রাখতে হয়। যে নারীর ঘরে বুয়া নেই বা বুয়া রাখার প্রয়োজনীয়তা বা সক্ষমতা নেই সেখানে গৃহিনী ঘরের কাজ করেন।

ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের একটি গবেষণা বলছে, ৮১ শতাংশ নারী সরাসরি গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত থাকেন।
একজন কর্মজীবি নারী বাসায় এসেও ঘরের কাজে লেগে পড়েন। কিন্তু পুরুষ এসে রেস্ট নেন, নয়তো আড্ডা দেন বন্ধুদের সাথে। সময় এসেছে এই কাজকে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করার। বছর তিনেক আগে সরকার থেকে নারীর কাজকে মূল্যায়নে কথা হলেও নেওয়া হয়নি এখনো কার্যকরি উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন।

উপজেলা নির্বাচন অফিসার আফরোজা রীতা বলেন,
‘নারীর কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি হওয়া উচিত। একজন নারী দিনের সম্পূর্ণ শ্রমঘন্টা গৃহস্থলী কাজে ব্যয় হয়। সুতরাং সামাজিক স্বীকৃতির পাশাপাশি আর্থিক মূল্যও হওয়া উচিত। কিন্তু ,এদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ প্রত্যাশা বহুদূর। তবু চেষ্টা করা যায় এই প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads