বেদৌরা বিনতে আফাক
দেড় বছরের পিঠাপিঠি ভাই-বোন নওশিন আর নিয়াজ। তিন বছরের নিয়াজ গোসলের পানি থেকে কিছুতেই উঠতে চায় না। পানি দিয়ে খেলায় মত্ত থাকে যতক্ষণ না তাকে জোর করে তুলে আনা হচ্ছে। অন্যদিকে নওশিন যখনই বুঝতে পারে তাকে গোসলের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় কান্না। খুব কষ্টে গোসল করাতে হয় তাকে। শিশুর পরিচর্যার অন্যতম অংশ হলো এই গোসল। নওশিন আর নিয়াজের মতোই গোসল নিয়ে শিশুদের মধ্যে দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। গোসলের প্রতি ভয় যেমন কাজ করে, তেমনি অনেক শিশুই আবার গোসলের সময়টায় বেশ আনন্দ পায়। গোসল নিয়ে শিশুর মধ্যে যেন কোনো ভীতি তৈরি না হয় এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য করা গোসল যেন আবার কোনো হানির কারণ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই শিশুর গোসলের কিছু প্রয়োজনীয় দিক জেনে নিন।
শিশুকে প্রস্তুত করে নিন
গোসল করানোর জন্য প্রথমেই শিশুকে প্রস্তুত করে নিতে হবে। হঠাৎ গোসলের বোল বা বাথটাবে বসিয়ে দিলে পানির সংস্পর্শে এসে গোসলের প্রতি শিশুর মধ্যে এক ধরনের ভয় জন্ম নিতে পারে। তাই প্রতিদিন গোসলের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। প্রয়োজনে ঋতু অনুযায়ী তেল মালিশ করে, গায়ের জামা বদলে দিয়ে, গোসলের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে রাখুন শিশুর সামনেই। এতে করে শিশু বুঝতে পারবে এখন তার গোসলের সময় এবং সে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবে।
গোসলের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও করণীয়
* শিশুকে গোসল করাতে নিয়ে যাওয়ার আগেই গোসলের প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম সেখানে গুছিয়ে রাখতে হবে, যাতে গোসলের মাঝে উঠে যেতে না হয়।
* গোসলের জন্য মৃদু গরম পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে গরম পানি ব্যবহার করতে না চাইলে পানিভর্তি বোলটি রোদে রেখেও পানিটা গরম করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে পানির ঠান্ডা ভাবটা একটু কমলেই হবে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে পানির উষ্ণতা পরীক্ষা করে নিতে পারেন।
* গোসলের সময় বোলে বা টাবে কী পরিমাণ পানি থাকবে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পানি এমনভাবে নিতে হবে, যাতে শিশুকে পানিতে বসানোর পর পানি কোনোমতেই তার কোমরের উপরে না ওঠে। কারণ অসাবধানতাবশত শিশু কখনো পিছলে গেলে যেন পানিতে ডুবে না যায়।
* গোসলের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে এবার শিশুকে গোসল করানোর পালা। এক্ষেত্রে প্রথমেই যে বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখবেন সেটি হলো, এক বছরের কমবয়সী শিশুর বেলায় তাকে সরাসরি পানিতে বসিয়ে দেবেন না। প্রথমে তার পা ভিজিয়ে নিন। এরপর আস্তে আস্তে পুরো শরীরে পানি দিন। হঠাৎ পানির সংস্পর্শে এলে শিশু ভয় পেয়ে যায়।
* গোসলের সময় অনেক ক্ষেত্রে শিশু পিছলে পড়ে যায়। সেজন্য গোসলের গামলা বা টাবে একটি তোয়ালে বা পাতলা কাপড় বিছিয়ে নিন। এতে শিশুর পড়ে যাওয়ার ভয় কমবে অনেকটাই।
* যে শিশুটি এখনো নিজে বসতে শেখেনি, তার বেলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গোসল করানোর সময় এ বাচ্চাদের মাথা ও ঘাড় হাতের তালুতে রেখে পানিতে বসাতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে।
* পাতলা নরম কাপড় দিয়ে শিশুর শরীর পরিষ্কার করা উচিত। শিশুর চোখ ও কানের বাইরের অংশ কটনবল দিয়ে পরিষ্কার করে দিন। গলা পরিষ্কার করে দিন। কারণ অনেক শিশুর মুখমণ্ডল বুকের সঙ্গে লেগে থাকে। ফলে ঘামে সেখানে সহজেই ময়লা জমে যায় এবং ঘা হয়ে যেতে পারে। তাই গোসলের সময় শিশুর শরীরের যে অংশগুলো ভাঁজ হয়ে থাকে, সেগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
* প্রতিদিন সাবান ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে শিশুর ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।
* পানি থেকে উঠিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নরম তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে নিতে হবে। ঋতু অনুযায়ী লোশন বা পাউডার দিয়ে পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে দিন।
গোসলের সময় খেয়াল রাখুন
* গোসলের সময় প্রথমেই শিশুর মাথায় সরাসরি পানি ঢালা থেকে বিরত থাকুন। আগে শিশুর হাতে-পায়ে পানি দিয়ে শিশুকে গোসলের জন্য তৈরি করে নিন।
* মগ দিয়ে মাথায় পানি না ঢেলে হাতে পানি নিয়ে আস্তে আস্তে মাথা ভিজিয়ে নিন। মগে পানি ঢাললে একসঙ্গে অনেক পানি পরে বলে শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তখন শ্বাস নিতে গিয়ে শ্বাস নালিতে পানি ঢুকে যেতে পারে। এছাড়া মাথায় বেশি পানি ঢালা হলে শিশুর ঠান্ডা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
* শিশুর যদি ঠান্ডা লাগার প্রবণতা থাকে, তাহলে গোসলের আগে শিশুর গায়ে তেল মেখে নিতে পারেন। এতে গায়ের পানি ঝরে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। ঠান্ডা লাগার ভয়ও থাকবে না।
* শিশুদের জন্য তাদের ত্বকের উপযোগী কম ক্ষারযুক্ত বেবি প্রডাক্টগুলো ব্যবহার করা উচিত। এক্ষেত্রে বড়দের সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি ব্যবহার না করাই ভালো।
* সাবান এবং শ্যাম্পু প্রতিদিন ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ এগুলো মৃদুমাত্রার হলেও তা প্রতিনিয়ত ব্যবহারের ফলে শিশুর ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।
* গোসলের পানিতে অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করলে অনেক উপকারী জীবাণুও মারা পড়ে। তাই গোসলের পানিতে অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার না করাই ভালো।