রাত তখন ৯টা। এই রাতেও অনেক মানুষ ঘরে ফিরছেন। রামপুরা হাজীপাড়ায় রাস্তার পাশে ভ্যান নিয়ে বসে আছেন মো. মিজানুর রহমান। অনেককেই কিনতে দেখা গেল। মিজানের কাছ থেকে জানা গেল এই বিকিকিনি শুরু হয় বিকাল থেকে। চলবে রাত ১১টা পর্যন্ত। তাই মিজানুরের অবসরের কথা চিন্তা না করে বেচাবিক্রির মধ্যেই কথা শুরু হলো। জানাচ্ছেন ইসরাত জাহান
এই বিক্রেতার বাড়ি সুদূর গাইবান্ধায়। জেলার সাদুল্লাপুর গ্রামে তার বসবাস। ঢাকায় আসেন ২০১০ সালে। জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমান। ঢাকায় এসে গার্মেন্টে কোয়ালিটি বিভাগে চাকরি নেন। কিন্তু বেতন কম থাকায় ৫ বছরের বেশি আর চাকরি করেননি। তাছাড়া পরের অধীনে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়াটাও মেনে নিতে পারছিলেন না মিজানুর। চিন্তা করলেন স্বাধীনভাবে কী করা যায়। হাতে পুঁজিও কম। পজিশনমতো একটা দোকান নিতেও অনেক টাকা লাগে। সব ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় গেঞ্জি, থ্রিপিস বিক্রি করবেন। জমানো টাকার কিছু দিয়ে ভ্যান কিনে বাকি টাকা দিয়ে গেঞ্জি, থ্রিপিস কিনলেন। এভাবেই শুরু। ব্যবসা ভালোই হয় বলে জানালেন।
‘প্রতিদিনই ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো থাকে। তবে কোনোদিন লাভ বেশি হয়, কোনোদিন কম হয়’- বলেন মিজানুর। পাইকারি দামে মালগুলো রাজধানীর বাবুর হাট, গাউসিয়া, গুলিস্তান, ট্রেড সেন্টার থেকে কেনেন তিনি। অনেক সময় গার্মেন্ট থেকেও ভালো কাপড় কেনেন। সপ্তাহে দুদিন পাইকারি বাজার করেন। নিজের পছন্দ নয় বরং ক্রেতার পছন্দের ওপর ভিত্তি করে কাপড় কেনেন মিজানুর। বলেন, ‘ব্যবসা করতে করতে জাইনা গেছি কোন কোন পোশাকের চল বেশি।’
এই ভ্যানের দোকানে তরুণ-তরুণীরাই মূল ক্রেতা। যাদের মধ্যে অনেকেই শুধু মিজানুরের কাছ থেকেই মাল নেন। এরকমই একজন গার্মেন্টকর্মী তসলিমা। ‘ওনার কাছে সব সময় কম দামে ভালো জিনিস পাই বলেই আসি’ বলেন তিনি। এ ব্যবসায় প্রায় ৩ বছর হলো তার। এর মধ্যেই বিয়ের পালা শেষ করেন মিজানুর। কথা বলতে বলতে মিজানুরের ফুটফুটে মেয়ে মীম এসে হাজির। মেয়েকে পেয়ে যেন সাত রাজার ধন পেলেন মিজানুর। স্বপ্ন দেখেন মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে অনেক বড় বানাবেন। ছোট বলে এখনো স্কুলে ভর্তি করাননি মীমকে। মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য এর মধ্যে টাকা জমাতে শুরু করেছেন বাবা। এর মধ্যে দেশ থেকে ফোন আসে মিজানুরের বাবার। বাবা মুক্তিযুদ্ধের ভাতা উঠিয়েছেন কি-না জিজ্ঞেস করলেন।
ঢাকা থেকে কালকের মধ্যেই বিকাশে বাবাকে টাকা পাঠাবেন বলে জানান। মোবাইল রাখার পর জিজ্ঞেস করলাম— ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমাকে তো আগে বললেন না?’
উত্তরে মিজানুর বললেন, ‘আমার বাবার নাম আবদুল আজিজ। কাউকে আগে বলি না আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তবে নিজেকে অনেক গর্বিত ভাবি আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে। আমার এই পরিচয় জানার পর অনেকে আমাকে দেখা করতে বলেছিল চাকরির জন্য। কিন্তু আমি যাইনি। আমি আমার মতো ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি। আমার গর্ব আমার কাছেই থাক।’
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এদেশের প্রতিটি মানুষ যাতে ভালোভাবে থাকে, সুন্দরভাবে থাকে, কারো যেন কোনো অসুবিধা না হয়, এই কামনাই করেন। একজন বাংলাদেশি এই পরিচয়টাই অনেক বড় মিজানুরের কাছে। মীম তখনো বাবার কোলে। রাত ১১টা ১০। এখনই গোছানো শুরু করবেন মিজানুর। পরে মেয়েকে নিয়ে ভ্যানে করে বাসার দিকে রওনা হবেন। মেয়েকে এই রাতে ভ্যানে নিয়ে আধাঘণ্টা ঘুরবেন। বাবা-মেয়ে খুনসুটি করবেন। আর সময় না নিয়ে হাঁটা ধরলাম। বাবা-মেয়ের এই একান্ত সময়টায় বিরক্ত না-ইবা করলাম।