বৈশ্বিক মহামারি করোনার দফায় দফায় হানায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। চরম সংকটে মানুষের জীবন ও জীবিকা। গোটা দেশেই এক মানবিক বিপর্যয়ে দিশেহারা মানুষ। গত বছর করোনার শুরুতে শনাক্ত ও আক্রান্তের হার বেশি ছিল নগর-মহানগরে। গ্রামপর্যায়ে করোনার তীব্রতা কমই ছিল। কিন্তু এ বছরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে শনাক্ত ও মৃত্যু অনেকটাই যেন গ্রামমুখী। তুলনামূলক আক্রান্ত ও মৃত্যু মফস্বল শহর ও গ্রাম পর্যায়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে। বিশেষ করে সীমান্তসংলগ্ন জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুগাঁও, নীলফামারী, রংপুর, পঞ্চগড় জেলার করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই বেড়ে চলছে। কুড়িগ্রাম জেলার অবস্থা এতই ভয়াবহ যে, প্রতিদিন জেলার ৯টি উপজেলায় গড়ে শনাক্ত শতকের ঘর যেমন অতিক্রম করছে, তেমনি মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এ জেলার মানুষের মধ্যে করোনা আতঙ্ক ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এর ওপর তো আবার দফায় দফায় লকডাউনে রুটি-রুজিও হুমকির মুখে ছিল। ফলে অভাব-অনটন দিনদিন তীব্র হচ্ছে। অনেক মানুষকে না খেয়ে কিংবা আধা পেটা খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। সর্বত্রই কাজ নেই, রুজি নেই অবস্থা। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজমান। লকডাউনের সময় পরিবহন খাতে জড়িত অটো, ভ্যান, রিকশাও ঠিকমতো চালাতে না পেরে কর্মজীবী মানুষের বেহাল দশা ছিল। যদিও এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। কিন্তু বিশেষ করে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়।
অথচ মধ্যবিত্তরাই অর্থনীতির বাতিঘর। অর্থাৎ মধ্যবিত্তরাই দেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির চাবিকাঠি। যাদের মধ্যে উদ্যোক্তা, ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকাংশেই নির্ভরশীল। সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা এতই করুণ যে, যাদের স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনতে ওএমএস ও টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। যারা না খেয়ে থাকলেও কাউকে বলতে পারে না সে কথা। এক নীরব দুর্দশায় পড়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। সে উপলব্ধি থেকে সরকার সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তার জন্য ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সংগ্রহের নিয়ম চালু করেছিল। সেখানে দিনে প্রায় ফোন আসত ৪৩ হাজার ৩৪১ জনের। এর মধ্যে গড়ে খাবার পেত মাত্র ১ হাজার ৭১২ জন। এমনকি অনেক সময়ই ৩৩৩ নম্বরও জনবল সংকটের কারণে খাবার সহায়তাকারী ইউনিটের পক্ষে ফোনে সাড়া দেওয়াই সম্ভব হয়নি। তবুও মানুষ খাদ্য সহায়তার আসায় ফোনে দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করেছিল।
মূলত দফায় দফায় করোনার ছোবলে বিপর্যয়ের মুখে ব্যবসা-বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যসহ গোটা অর্থনীতি। কেড়ে নিয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকা। দরিদ্রকে করেছে অতিদরিদ্র, ব্যবসায়ীকে করেছে পুঁজিহারা, মধ্যবিত্তকে পড়তে হয়েছে চরম অর্থনৈতিক সংকটে। অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিসহ বৃহৎ ও মাঝারি ধরনের শিল্পেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকার করোনা পরিস্থিতিতে কঠোর লকডাউন দেওয়ায়, গোটা দেশে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। ফলে এ খাতের সঙ্গে যুক্ত লাখ লাখ পরিবারের দুর্দশার শেষ ছিল না। অবশ্য লকডাউনের কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই কিছুটা কমে এসেছে সত্য। এরই মধ্যে মানুষের জীবিকার তাগিদে ও অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে লকডাউনও প্রত্যাহার করেছে। যদিও অনেকেই মনে করেন, আরো দুই সপ্তাহ লকডাউন রাখা উচিত ছিল। লকডাউনের পক্ষে-বিপক্ষে যেভাবেই কথা বলি না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে—জীবন-জীবিকা অর্থনীতি শিল্পকারখানা, দেশি-বিদেশি ব্যবসা সবকিছুকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। তবে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যে প্রবণতা সেটি বৃদ্ধি পেলেও মানুষ শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করছে না। শঙ্কার জায়গাটা এখানেই! কিন্তু মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন নেয়ার ক্ষেত্রে যে অনিহা ছিল, সেটা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। এখন অধিকাংশ মানুষই ভ্যাকসিন নিতে চায়। এ জন্য বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। আবার অনেকেই দৌড়ঝাঁপ করলেও ভ্যাকসিন নিতে পারছেন না। বিশেষ করে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র হয়নি তাদেরকেও টিকার আওতায় আনতে হবে। কারণ শিশুসহ তাড়াও তো আক্রান্ত হচ্ছেন। তাহলে জাতীয় পরিচয়পত্রের বদলে জন্ম সনদ কিম্বা নাগরিকত্ব সনদে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দিয়ে তাদেরকেও টিকার আওতায় আনা হবে না কেন? বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন নিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ একমাত্র টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেই এই মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচানো যেতে পারে।
যদিও গত বছরের মার্চে আমাদের দেশে প্রথম করোনা আঘাত হানে। সে সময় ভ্যাকসিনও আবিষ্কৃত হয়নি। আবার যেসব দেশে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়েছিল, তারা নিজেদের জনগণকে বাঁচাতেই তারা ব্যবহার করেছে। বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন শুরু হলেও আমাদের দেশের সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে একমুখী প্রচেষ্টায় ভ্যাকসিন কেনার কারণে আমাদেরকে ভ্যাকসিন সংকটে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের ভয়াবহ অবস্থায় তারা ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করলে গভীর সংকটে পড়তে হয় আমাদের। অথচ শুরু থেকে বর্তমানের ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টার মতো উদ্যোগ নিলে এ ধরনের ভ্যাকসিন সংকটে হয়তো পড়তে হতো না। অনেক সময় স্বার্থান্বেষী অনেকের স্বীয় স্বার্থে দেওয়া পরামর্শও সরকারকে গুরুত্ব দিতে হয়। পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী। আর এ ধরনের প্রবণতা নতুন কিছু নয়, পুঁজিবাদী অর্থনীতির রাষ্ট্র কাঠামোয় সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ প্রাধ্যান্য পেয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
অথচ জীবন আগে তারপর জীবিকা। সেই জীবন রক্ষায় মানুষ অসহায়ের মতো মারা গেছে। চোখের সামনে প্রিয় স্বজনকে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে। হাসপাতালে বেড নেই, আইসিসিইউ নেই, অক্সিজেন সংকট, এমনি নানামুখী সমস্যা তো এখনো বিদ্যমান। অবশ্য গত বছর শুরুতে আমাদের দেশে করোনার আঘাতটা দ্বিতীয় আঘাতের চেয়ে অনেকটাই কম ছিল। অর্থনীতির চাকাও সচল ছিল। কিন্তু এ বছর করোনার আঘাতে দেশের অর্থনীতি যেমন দুর্বল হয়েছে, তেমনি মানুষের কর্মহীনতা, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বলেন, এ বছরের করোনার দ্বিতীয় আঘাতে অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হয়েছে। বিপর্যয়ের মুখে পড়া অর্থনীতিকে ফিরিয়ে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। অবশ্য করোনার প্রকোপে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিও নাজুক ছিল। তবে তারা ভ্যাকসিন নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পুরোদমে শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছে। ফলে সেসব দেশের আমদানি-রপ্তানিমুখী ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরেছে। তারা এখন আমাদের দেশ থেকে পণ্য নিতে অর্ডারও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতিরও গতি ফিরবে, সন্দেহ নেই। যে কারণে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগে বাধ্যবাধকতা জারি করে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে হবে। কারণ শিল্পকারখানার শ্রমিকরাই অর্থনীতির বড় কারিগর। তাদের বাঁচাতে হবে। তারা না বাঁচলে অর্থনীতিও বাঁচবে না। অথচ শুধু দূরদর্শিতার অভাবে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনা কালেও রেমিট্যান্স ও পাটসহ অন্যান্য খাতে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ভাল ছিল। সব মিলে আশার আলো নিভে যায়নি। আমরা মনে করি, দেশের প্রতিটি মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা ঋণ করে হলেও প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়া নির্ভর করছে সবাইকে করোনার টিকা দেওয়ার ওপর। যেখানে সরকার বলছে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে এক বছর সময় লাগবে। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের হতাশ করে। কারণ এক বছর সময় লাগবে কেনো? টিকা সংগ্রহ দ্রুত করতে হবে এবং এক বছরের মধ্যে শতভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি সকলকে সচেতনও হতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যেন আর কোন লকডাউনের মুখে আমাদের পড়তে না হয়। আর এ কারণে সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বও অপরিসীম, তা কি অস্বীকার করা যাবে? সংগত কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই অর্থনীতিকে পুনর্জীবিত করে আমাদের বাঁচতে হবে। এ ক্ষেত্রে সকলকেই দায়িত্ববোধেরও পরিচয় দিতে হবে।
লেখক : সমাজ বিশ্লেষক