ফিচার

করোনাকালে ভাস্কর দম্পতির শিল্পচর্চা

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল, ২০২১

শিল্প চায় সম্মান, আদর ও ভালোবাসা। শিল্প ও প্রেম একে অপরের পরিপূরক। বিশেষ করে ভাস্কর্য শিল্পের বেলায় এ কথাটি ভীষণভাবে প্রযোজ্য। স্থাপত্যের সঙ্গে ভাস্কর্যের সবিশেষ মিল পাওয়া যায়। ভাস্কর্য শূন্যতাকে শোষণ করে নির্মিত হয়। ভীষণ নিঃশব্দ আর প্রতীকমুখী এ শিল্প। সরাসরি এবং স্পষ্ট। যার মধ্যে কৃত্রিমতার ছিটেফোঁটাও নেই। দেশের অন্যতম প্রধান ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। জলরং, তৈলচিত্রের পাশাপাশি নিয়মিত ভাস্কর্যশিল্পের চর্চা করেন। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সমান জনপ্রিয় আধুুনিক এই ভাস্কর্যশিল্পী। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল অলিম্পিক পার্কে একজন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তার একাধিক শিল্পকর্ম স্থাপিত হয়েছে। অলিম্পিক পার্ক ছাড়াও আরো কয়েকটি পার্কে তার কাজ স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে আইভি জামান বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পে অন্যতম নাম, একজন মননশীল ভাস্কর্যশিল্পী। ভাস্কর্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কাছে আইভি জামানকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় বহন করেন তার কাজের মাধ্যমে। প্রখ্যাত ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের সহধর্মিণী হয়েও আইভি জামান নিজের কাজে আলাদা স্বকীয়তা তৈরি করে নিয়েছেন। করোনকালে বসে থাকেননি এই গুণী দম্পতি। চালিয়ে যাচ্ছেন শিল্পচর্চা। তাদের সাথে কথা বলে লিখেছেন সালেহীন বাবু-

শিল্পী আইভি জামানের ভাস্কর্য নিয়ে সমালোচকরা বলেন, ‘কখনো কখনো তার কাজ গানের মতো, স্পষ্ট বোঝা যায়, কখনো বোঝা যায় না। আস্তে আস্তে, বার বার দেখতে গিয়ে, একটার পর একটা ইমেজ আলাদা মনে হয়। প্রতিটা ইমেজের আলাদা অর্থ আছে। চোখ বুজে তাকালে, রং ও রেখা আলাদা হয়ে ধরা দেয়, ঘূর্ণনের মতো। একটা ঘূর্ণন আর একটা ঘূর্ণন তৈরি করে। এসব ঘূর্ণন অনেকটা অ্যাবস্ট্রাক্ট, শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব না।’

করোনাকাল কেমন কাটছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘করোনার এই সময়টাতে সংসারের সবকিছু নিজেকেই করতে হচ্ছে। আমি যে এত কাজ করতে পারি তা ভেবেও অবাক হচ্ছি। এর ফাঁকে যখনই সময় পাচ্ছি ছবি আঁকছি। স্কাল্পচার করছি। কারণ এই সময়টাতে মনের যে অবস্থা তা যদি আমি এঁকে প্রকাশ করি তাহলে অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছি। তাই ছবি এঁকে দুঃসহ এই সময়টা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। মনটা সবসময় অস্থির হয়ে আছে, প্রতিদিন দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। কখনো কখনো নিজেরা আক্রান্ত হচ্ছি কি না এ নিয়েও আতঙ্কিত হচ্ছি। ভয়ে ভয়ে থাকি একার জন্য নয়, সবার জন্য। আমার দেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য। যদিও আমরা আপাতত ঘর থেকে বেরুচ্ছি না, তারপরও সবার জন্য মন কাঁদছে। করোনাকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।’

আপনি বললেন ছবি আঁকছেন, আপনার এসব ছবিতে করোনার কোনো প্রভাব আছে কি? বিশিষ্ট এই শিল্পী বলেন, ‘হ্যাঁ, করোনার প্রভাব তো আছেই। করোনা ভেতরটাকে বেশ নাড়িয়ে দিচ্ছে। সরাসরি তো করোনার ভয়ংকর রূপ আঁকা যায় না। এটার নান্দনিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রকৃতিরও অনেক ভাস্কর্য আছে। আমার ভাস্কর্যের অনেক বিষয়ই প্রকৃতি থেকে নেওয়া। আমি মনে করি প্রকৃতিই আমার ক্লাসরুম। আমি প্রকৃতি থেকে নিই, তবে হুবহু নয়। স্বস্তি যেন ফিরে আসে এমন ছবিও উঠে আসছে তুলির আঁচড়ে। এ কারণে গ্রামবাংলার ছবিও আঁকছি, পাশাপাশি করোনার আগের সময়ের ছবিও আঁকছি। মাথায় সব ঘুরছে। তবে সময়টা নষ্ট না করে ছবি আঁকাটাই বেশি করছি। আমি দুটি ভাস্কর্যের কাজ শেষ করেছি। বাকি ১০টির কাজ ওয়ার্কশপে আছে। মাঝে মাঝে আমার ওয়ার্কশপে যেতে হয়। কাজ দেখার জন্য। জানি এটা জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে যায়। তাও যাই। এর পাশাপাশি ওয়াটার কালারের কাজও করছি। কাজের মধ্যে থাকলে অনেক কিছুই ভুলে থাকা যায়। পাশাপাশি হামিদুজ্জামানকে সাহায্য করছি ছবি আকার ব্যাপারে। পুরো বাসায় আমরা দুজনই। এভাবেই সময় কেটে যায়।’

আইভি জামান আরো বলেন, ‘করোনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি আমাদের একটা শিক্ষা দিল। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের আচরণ ভালো করতে হবে। প্রকৃতি যাতে ভালো থাকে সে চেষ্টাই আমাদের সবাইকে করতে হবে। আমরা যাতে কোনো প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস না করি। সবাই এই পৃথিবীকে এসেছে জীবনটা বাঁচাতে। সে জীবনটা যেন স্বস্তিতে থাকে। এই পৃথিবীতে সবার অধিকার সমান। কীটপতঙ্গ, প্রাণী এসবেরও বাঁচার অধিকার আছে। তাদের বিরক্ত করা যাবে না। এটা আমাদের অনুভব করতে হবে। যেমন এই যে হাত ধোঁয়ার অভ্যাসটা আমার বরাবরেরই অভ্যাস। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। ছোটবেলায় থেকেই তাকে দেখতাম সবসময় হাত-মুখ ধুতেন। বাবার মতো আমারও সে অভ্যাস আছে। তবে এখন ডাবল করতে হচ্ছে, সারাজীবনে যা করিনি তা মনে হচ্ছে পুষিয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পরপরই হাত পরিষ্কার করছি। আমার মতো সবাইকেও দেখছি, তা মানছে। তবু সংক্রমিত হচ্ছেই, কমছে না কিছুতেই। তবে আশা করছি কমে যাবে।’

করোনার কারণে আপনার চেনা পৃথিবীটার কতটা বদল ঘটেছে বলে মনে করছেন? আইভি জামান বলেন, ‘কেবল আমার নয়, সারা পৃথিবীর মানুষেরই জীবন আমূল বদলে গেছে। আমি আশাবাদী এটা ঠিক হয়ে যাবে। আগে বাইরে বেরুলে ধোঁয়ার দূষণ, ধুলার দূষণ নাকে লাগত, দম বন্ধ হয়ে আসত। এখন তা কমে গেছে। চারদিকে ঘন সবুজ যেন আরো ঘন এবং সতেজ হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে কি, আমরা পৃথিবীর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেছি। এর মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনে একটা বড় শিক্ষা হলো। আমরা অপ্রয়োজনে কিছু করব না। যেটা করলে প্রকৃতির কষ্ট হবে বা প্রকৃতি দূষণ হবে এমন কাজ করব না। পাশাপাশি হাত ধোয়ার অভ্যাসটা যেন আমাদের সবার থাকে।’

আত্মবিশ্বাসী এই শিল্পী বলেন, ‘দেখবেন আমরা করোনাকে জয় করবই। এখন সেই গানটাই বেশি মনে পড়ছে-আমরা করব জয় একদিন।’

(চলবে)

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads