এবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম!

প্রতীকী ছবি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

এবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১২ জুন, ২০২২

বিদ্যুৎ খাতে বিদ্যমান ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে চায় না সরকার। তাই গ্যাসের পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দিকে এগোচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী জুলাই মাসে বাড়ানো হতে পারে বিদ্যুতের দাম। তবে কত বাড়বে তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)।

এরমধ্যে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কমেছে ৫ দশমিক ১৬। বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বলেছে, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে প্রায় দিগুণ। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া লোকসান কমানোর অন্যকোনো উপায় দেখছে না নীতিনির্ধারাকরা।

তবে ন্যূনতম বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে চেষ্টা করবে বলে জানায় বিইআরসি। কিন্তু ভোক্তা অধিকার বিষায়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এই মুহূর্তে গ্যাসের পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। আর এটি সামনে রেখে এ খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চায় সরকার। তবে এ মুহূর্তে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা ভর্তুকি কমানোর প্রভাব জনজীবনে পড়বে। এ খাতে আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হলেও এবার কমেছে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। চলমান বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। যদিও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে (২০২২-২৩) ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এবার উন্নয়ন বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। তাই বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে জনস্বার্থে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাড়নোর পরামর্শ তাদের।

বিইআরসি সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিট প্রতি ৫ দশমিক ১৭ টাকা নির্ধারণ করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২ দশমিক ১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪ দশমিক ২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবির।

বিদ্যুতের দাম বাড়াতে গত মাসেই গণশুনানি সম্পন্ন করেছে বিইআরসি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিইআরসির কারিগরি কমিটি সুপারিশও করেছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫ দশমিক ১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। বিপিডিবির এই প্রস্তাব গ্যাসের বর্তমান দর বিবেচনায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯ দশমিক ১৪ টাকা এবং ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯ দশমিক ২৭ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি হলেও খুচরা কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, সাধারণত জ্বালানির দাম ১০ ভাগ বাড়লেই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়। এবার সেখানে ১৩ ভাগের কাছাকাছি গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। আর দেশের মোট বিদ্যুতের এখনো ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ গ্যাস দিয়ে উৎপাদন করা হয়। তাছাড়া বিদ্যুতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য নতুন করে ডিমান্ড চার্জ আরোপিত হলো। এতোদিন গ্যাসের কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে ডিমান্ড চার্জ চাইলেও তারা বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছিল না। এবারের গ্যাসের শুনানিতে কোম্পানিগুলো আবারো বিষয়টি তুলে ধরে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে বলা হয়, প্রতি ঘনমিটারে ০ দশমিক ১০ টাকা ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করতে হবে। তার অর্থ এখন থেকে গৃহস্থালি ছাড়া অন্য সব গ্যাস গ্রাহককে প্রতি ঘনমিটারে ০ দশমিক ১০ টাকা ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করতে হবে। যদিও আগে অন্যান্য গ্রাহক শ্রেণি ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করলেও সরকারি বেসরকারি ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করতো না।

এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে পড়ছে কমিশন। তারপরও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কমিশন কাজ করতে পারছে না। ক্যাবের পক্ষ থেকে যে ২৫ দফা প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল সেখানে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে কাজ করা এবং আন্দোলনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিশনকে ওই ধারার বাইরে আনা না গেলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে না। বরং হঠাৎ করেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি এখন কোম্পানিগুলোর জন্য সহজ হয়ে গেল।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দিতে চায় না। পাইকারিভাবে বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৩৯ পয়সা বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতদিন সরকার ৩ টাকা ৩৯ পয়সা ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাব গ্রহণ করলে সরকারের আর ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না।

তিনি বালেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাইকারি বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। বিদ্যমান পাইকারি মূল্য হার ৫ টাকা ১৭ পয়সা। মূল্য হার ঘাটতি বিবেচনায় নিয়ে পাইকারি বিদ্যুতের রাজস্ব চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং মূল্য হার ৮ টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঘাটতি সমন্বয়ে সরকারি ভর্তুকি বিবেচনা করা হয়নি। তার মানে যখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করে, তখন সরকার ভর্তুকি দিতে রাজি হয়নি।

এ বিষয়ে বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কমিশন পর্যালোচনা করবে। পোস্ট হেয়ারিংয়ের কাগজপত্র জমা পড়েছে। ন্যূনতম বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কমিশন চেষ্টা করবে। তবে কত বাড়বে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এটা কমিশনের পর্যালোচনা সভার পর ঠিক করা হবে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের দামও বাড়বে। তবে সেটি কত ভাগ বাড়বে তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। তবে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণের দায়িত্ব বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। তারা প্রমাণ করতে পারলে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ ও ন্যায়সঙ্গতভাবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads