খায়রুজ্জামান খান
বুদ্ধিজীবীরা হলো একটি দেশের সেরা মস্তিষ্ক এবং একটি জাতির বিবেক। মূলত একটি বিশেষ অবস্থান অর্জনের পর শুধু সে বিষয়ে দক্ষতা এবং সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে জাতির অগ্রগতিতে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়। তারা দার্শনিক, গবেষক এবং জাতির পথপ্রদর্শক। একটি বিষয়ে তারা সঠিক বিশ্লেষণ করে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ সমাধানে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখেন। যৌক্তিক উপায়ে চিন্তা করার দক্ষতা রাখেন। সত্য প্রকাশে দৃঢ়। বাস্তবতা তুলে ধরতে অনড়। তারা মানুষের এবং দেশের আদর্শবাদ ও সত্যের হাতিয়ার বাঁচিয়ে রাখে। তাই পরাজিত বাহিনীর নীলনকশা ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করা। যার শুরু ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকেই।
বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক অধ্যায়ের নাম বুদ্ধিজীবী হত্যা। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালির মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনার সঙ্গে একসাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালে খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫ মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। ইতিহাসের পাতায় কালো অধ্যায় হয়ে বাঙালির মনে ক্ষত হয়ে থাকবে। কারণ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ ও কর্মকাণ্ড দেশের সর্বস্তরের জনগণের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু এসব সত্যের পথ প্রদর্শক এবং দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা নিজ স্বার্থ দেখেছিল, সেসব মানুষের সঙ্গে শত্রুতায় জড়িয়ে যায়।
কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিকসহ বিশিষ্ট বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাড়ি থেকে তুলে আনা হয় এবং গেস্টাপোর রায়েরবাজার বধ্যভূমি এবং মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। তাদের হাত পেছনে বাঁধা ছিল এবং মাথায় গুলি করা হয়েছিল। বর্বর হত্যাকাণ্ডে পরবর্তী সময়ে তাদের নামমাত্র শনাক্ত করতে পেয়েছিল। দেশের সোনার সন্তানদের এভাবে হত্যার পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তথাকথিত গভর্নর, মেজর জেনারেল রাও ফোরমান আলী। তিনি বুদ্ধিজীবী ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণিকে হত্যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজির তত্ত্বাবধানে গঠিত আধাসামরিক বাহিনী আল-বদর ছিলেন সেই জঘন্য গণহত্যার উদ্বোধক। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অপহরণ এবং হত্যার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক প্রকাশ করা। তার প্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অনেককে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়, আবার অনেকের চোখ উপড়ে ফেলা হয়, অনেককে এতটা নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় যাদের পরে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। যাদের মধ্যে বধ্যভূমি থেকে অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. আলীম চৌধুরীকে চিহ্নিত করা যায়, যদিও শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এবং আরো অনেককে চিনতে পারেনি। ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
নবগঠিত দেশটিকে পঙ্গু ও দুর্বল করে দিতে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতির জন্য যা ছিল অকল্পনীয়। আমরা যা হারিয়েছি তা ফিরে পাওয়ার নয়। বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত্য তথ্য অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় শিক্ষাবিদ ছিলেন সর্বোচ্চ, যা দেশের মেধাশূন্যের কোটায় সর্বোচ্চ। অবৈধ ও সুবিধাবাদী স্বাধীনতাবিরোধী মানুষের ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছিল বুদ্ধিজীবীরা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বুদ্ধিজীবীদের শনাক্ত করতে সহায়তা করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তুলনামূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী এবং তথাকথিত সাংবাদিকদের ব্যবহার করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর অপহরণ অভিযানের কথা বিবেচনা করে রাও ফোরমান আলী বুদ্ধিজীবী হত্যায় আল-বদর বাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন।
আমরা যদি দেশের উন্নয়নের দিকে তাকাই, দেশের অগ্রগতিতে যাদের ভূমিকা মুখ্য ছিল বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সর্বাধিক। সুতরাং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও জাতীয় উন্নয়নের অগ্রযাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন বা কয়েক মাস মারা যাওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শের দ্বারা আলোকিত হতে পারি। আমাদের উচিত বুদ্ধিজীবীদের প্রতিটি সময়, প্রতিটি সেকেন্ড তাদের আত্মত্যাগের কথা সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা এবং তাদের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করা।
লেখক : শিক্ষর্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া