ভোর ৬টা ৩০ মিনিট। তড়িঘড়ি করে মনোহারী দোকান খুলছেন বুলবুলি বেগম। প্রতিবেদককে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে কেটলি ভরে গরম পানি চড়ালেন চুলায়। আরেকটি কেটলিতে চা পাতা দিলেন। দোকান হালকা ঝাড়ও দিলেন নিজ হাতে।
এর মধ্যে চায়ের পানি গরম হয়ে গেল। এই সকালেই চায়ের জন্য দোকানের সামনের কাঠের বেঞ্চে বসে আছে বেশ কয়েকজন। সবাইকে চা দিয়ে কিছুটা হাঁফ ছাড়লেন। তারপর বললেন, বলেন কী জানতে চান।
বুলবুলি বেগমের সঙ্গে কথা বলেছেন ইসরাত জাহান
কেমন আছেন?
এই যেমন দেখতাছেন তেমনি। খুব ভোরে দোকান খুলি, আর রাত ১২টায় যাই। কেমনে দিন যায়, রাত যায় ঠাহর পাই না। এমনেই যাইতাছে জীবন।
ঢাকা শহরে কতদিন ধরে?
১৯৯৫ সাল থেইক্যা। ২৪ বছর দেখতে দেখতে চইল্যা গেছে।
আপনার দেশের বাড়ি?
আমার দেশের বাড়ি জয়পুরহাট, থানা পাঁচবিবি, গ্রাম উচিতপুর।
ঢাকায় আসার পর কী করতেন?
ঢাকায় এসে ইপিজেডে চাকরি নিই। একটি গার্মেন্টে সুইং হেল্পার হিসেবে যোগ দিই। দুই মাসের মধ্যে প্রমোশন পেয়ে সুইং অপারেটর হই। তারপর অনেকদিন চাকরি করছি। দুই বছর হলো চাকরি বাদ দিছি।
কেন, চাকরি কি চলে গেছে?
না, যতদিন চাকরি করেছি কেউ আমার ভুল ধরতে পারেনি। এই ব্যবসার জন্য দুই বছর আগে চাকরি ছাড়ি।
কেন, আপনার স্বামী এনামুল হক কি আর দোকানে বসে না?
বসে। কিন্তু এত বড় দোকান, ও একা দেখতে পারে না। তাছাড়া হিসাব-কিতাবেও পটু না। বেচারা সহজ সরল। এখন দোকানের যে হাল, দুই বছর আগে তেমন ছিল না। দোকানের অবস্থা হয়েছিল করুণ। সে সময় দোকানে প্রচুর লোকসান হয়। অনেক মানুষ ২০-৩০ হাজার টাকা বাকি খেয়ে সটকে পড়ে। অনেকে আবার অর্ধেক টাকা দিছে। বাকি টাকা মাইরা খাইছে। আমি তখন চাকরি করতাম। যখন দেখলাম দোকানের এ হাল, ব্যবসা তো লাটে উঠছে, ভেবে-চিন্তে চাকরি ছেড়ে দিই। তারপর ব্যবসার হাল ধরি।
দুই বছর ধরে হাল ধরেছেন, এখন কী অবস্থা?
ইনশাল্লাহ ভালো। আগের থেকে এখন বেচাকেনা অনেক ভালো। এখন আর আগের মতো বাকি যায় না। বাকি দিলেও আমি নিজে হিসাব রাখি। তবে চোখ-কান সবসময় খোলা রাখতে হয়।
এত সজাগ থাকতে হয় কেন?
দুনিয়ায় মানুষ চেনা বড় দায় গো বাপু! রঙিন দুনিয়ায় রঙের রঙের মানুষ। খদ্দেরকে চা দিলাম, সিগারেট দিলাম, সব দিলে বিল হয় ৬০ টাকা, দেয় ৫০ টাকা। চোখে-মুখে মিথ্যা বলে। এক বিক্রিতেই যদি ১০ টাকা লোকসান হয়, তাহলে সারাদিনে কত টাকার লোকসান হতে পারে! আবার আরেক খদ্দেরকে মুদি জিনিস দিতে গেলে আরেকদিক থেকে লাড্ডু-বিস্কুট খেয়ে অস্বীকার করে। পরে দাম দেয় না। তাই সবদিকে চোখ রাখি। অবশ্য সব খরিদ্দার একরকম না।
সারাদিন দোকানে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। বাসায় সময় দেন কখন?
সারাদিনের মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে আমার মেয়েকে স্কুলে পাঠাই। বাসায় গিয়ে রান্নাও কইরা আসি। সে সময় এনামুল (স্বামী) সময় দেয়। আমার এক পোলা, এক মাইয়া। পোলা কলেজে পড়ে আর মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। সব দিকই ঠিক রাখতে হয়।
সারাদিন এত পরিশ্রম করেন, কষ্ট লাগে না?
কেন কষ্ট লাগব? সৎ পয়সায় খাই, কামাই করি, হয়তো শারীরিক পরিশ্রম হয়। তাও কষ্টকে কষ্ট মনে হয় না। দম ফেলার সময় পাই না। মনোহারী দোকান হলেও চায়ের খদ্দের বেশি। আর আমি ভেজাল জিনিস বেচি না।
তবে কি সারা জীবন এভাবেই চলবে?
মোটেও না। আমি আমার সন্তানদের পড়াশোনা করাইয়া শিক্ষিত বানামু। আর আমরা দেশে যামুগা। সেখানে নতুন দোকান দিমু। শেষজীবনে নিজের গ্রামে থাকতে চাই।