উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের প্রশ্ন

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের প্রশ্ন

  • আনু মুহাম্মদ
  • প্রকাশিত ২৯ জানুয়ারি, ২০২১

পরিণত অর্থনীতির পথে : স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে একটি দেশ অপরিণত একটা অবস্থা থেকে পরিণত অবস্থার দিকে যাচ্ছে। সরকার যেভাবে পরিকল্পনা করছে, বড় বড় প্রকল্প যেভাবে বাছাই করছে, যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করাচ্ছে, তাতে উন্নয়নের একটা ধরন দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটা কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। দীর্ঘ মেয়াদে দেশের মানুষের কী হবে, সেটা মাথায় রেখে পরিবেশের কথা চিন্তা করে প্রকল্প বাছাই হচ্ছে এটা বলা যাবে না। আরো প্রশ্ন হলো, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের অধিকারের বিষয় কী হবে? গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কতটা কার্যকর?

আগামী বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তা মোকাবিলা করতে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসায় জনগণের যে প্রয়োজন, তার যে চাহিদা ও অধিকার সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের নির্বাচন থেকে শুরু করে আইন-বিচার বিভাগসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটা স্বাধীন জায়গাতে আনতে হবে। প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছতা থাকতে হবে, জবাবদিহি থাকতে হবে। এখন আমাদের দেশে রাস্তা ও সেতু যেগুলো নির্মাণ হচ্ছে, সেটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। এত ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক প্রশ্ন। যে কাজ ভারত ১২ কোটি টাকা দিয়ে করে, চীন ৯ কোটি টাকা দিয়ে করে, যুক্তরাষ্ট্র ১২ কোটি টাকা দিয়ে করে, সেই কাজ যদি বাংলাদেশ ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে, তবে বুঝতে হবে এখানে ফাঁক-ফোকর আছে।

আমাদের প্রথমে জিডিপির পেছনে না দৌড়ানোর শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি মানেই উন্নয়ন না। প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে কি না, বিশুদ্ধ বাতাস পাচ্ছে কি না,  শিক্ষা ও চিকিৎসা পাচ্ছে কি না, নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারছে কী না, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে কি না, তার খেলার জায়গাটা বা বিনোদনের ক্ষেত্র ঠিক আছে কি না? সেগুলো নিশ্চিত হওয়া। কেননা এগুলোই উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি। বাংলাদেশে এখন জিডিপি বাড়ছে কিন্তু ওপরের সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক অবস্থা, সম্মানজনক কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। তার মানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও তার সুফল আসছে না বা গুণগত মান মিলছে না। পাশাপাশি যদি আমরা ভুটানের কথা বলি তারা কিন্তু এলডিসি থেকে ঠিকই বের হয়েছে, তবে তারা শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে জোর দেয়নি। তাদের উন্নয়নের মাপকাঠি হলো জনগণের সুখ!

জনসম্পদকে কাজে লাগাতে হবে : তরুণ জনসংখ্যা আমাদের অনেক বেশি। এটা আমাদের জন্য একটা আশীর্বাদ। পৃথিবীর অনেক দেশে এ সুযোগ নেই। যেমন জাপান। জাপানে বয়স্ক লোক বেশি। তারা তরুণদের পাচ্ছে না। ইউরোপের বহু দেশ আছে তারা বিপদের মধ্যে আছে। তাদের তরুণ জনসংখ্যার অনুপাত খুব কম। তারা সেজন্যই বিদেশ থেকে মাইগ্রেশন অনুমোদন করে। ভিন্ন দেশের তরুণদের আমন্ত্রণ জানায় কাজের জন্য। এ ঘটনা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রেও। পৃথিবীর এতগুলো দেশ যেখানে তরুণ জনগোষ্ঠীর অভাবে আছে সেখানে বাংলাদেশ নিজেরই বিশাল তরুণ জনসংখ্যা আছে। এ জনসংখ্যা কাজে লাগাতে হলে শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য ও বিনোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া তাদের যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াও বাড়াতে হবে।

দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক কাজ করে। এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার লোকজনও কাজ করে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের লোকও কাজ করে। কেন তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়? বলা হয়, বাংলাদেশে যোগ্য লোক তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশের তরুণদের একটা বড় অংশ আবার সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। তবে বাংলাদেশের তরুণরা কেন কাজের যোগ্য হচ্ছে না? সহজেই বুঝে নিতে হবে আমাদের শিক্ষায় ঘাটতি আছে। কিংবা এসব নিয়োগের পেছনে অন্য কারণ আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং বাণিজ্যিকীকরণে মানুষের উৎপাদনশীলতাও কমে যাচ্ছে। যথাযথ কর্মসংস্থান না হওয়ার কারণে সমাজে অর্ধবেকারত্ব প্রকট হচ্ছে। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি মানুষ এখন ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে। এটাকে বলা যায় কোনোরকমে কিছু না কিছু করে বেঁচে থাকা। এ দেশের মানুষ বিশেষত তরুণরা তো কাজ করেই খেতে চাচ্ছে অথচ যথাযথ কাজ পাচ্ছে না। এ সমস্যা সমাধানে তরুণদের যোগ্য করে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে। তাকে কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। উল্টো কলকারখানা বন্ধ করে দিয়ে নতুন বেকার তৈরি করা হচ্ছে।

আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ দেয়। কারণ তারা বিদেশিদের ওপর বেশি আস্থাবোধ করে। সরকারকে এসব প্রতিষ্ঠানে দেশি তরুণদের নিয়োগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সমর্থন জোগাতে হবে। যদি বিদেশি নিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবণতা খুব বেশি হয়, তবে সেখানে সরকার প্রণোদনা দিতে পারে যে দেশি চাকরিজীবী হলে কোম্পানিকে এই এই সুযোগ দেওয়া হবে।

বেকার সমস্যা : প্রয়োজনীয় প্রত্যেক খাতে ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার আছে। যেমন আমাদের দেশে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু গাড়ি চালকের প্রশিক্ষণের ইনস্টিটিউট প্রয়োজনীয় সংখ্যার চাইতে অনেক কম। গাড়ি চালকরা অর্ধ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং নিজে নিজে কোনোরকমে শিখে চালক হচ্ছে। যার কারণে দেখা যাচ্ছে দুর্ঘটনার মাত্রাও বাড়ছে। তার মানে হচ্ছে, যে ধরনের কর্মসংস্থানের চাহিদা তৈরি হচ্ছে, সে চাহিদা অনুযায়ী যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, যে ধরনের প্রণোদনা দরকার, সেটা নেই। যার কারণে আমাদের দেশে অনেক প্রকৌশলীসহ উচ্চশিক্ষিতরা বেকার থাকে। তাদের কাজের সুযোগ বা প্রণোদনা নেই। কাজেই কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে, সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে জনশক্তির দক্ষতা বাড়াতে হবে। তবেই বেকারত্ব কাটবে। এক্ষেত্রে সরকার বেসরকারি খাতকে কাজের ক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে কোন কোন খাতে কী পরিমাণ লোক লাগবে তার হিসেব বের করার দায়িত্ব দিতে পারে। এরপর সরকার সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। আবার তরুণদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনাও রাখতে পারে। অর্থাৎ সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।

ব্যাংক খেলাপি ঋণ : ব্যাংক খাতে বড় বড় ঋণ খেলাপি যারা, তাদের তৎপরতা বন্ধ করতে সরকারকে আরো বেশি কঠোর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যারা ঋণ খেলাপি তাদের বাড়তি সুবিধা না দিয়ে তাদের কাছ থেকে খেলাপির অর্থ আদায় করতে হবে। তাদের অধিকতর ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। যে ব্যাংকগুলো দুষ্ট লোকদের দ্বারা পরিচালিত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না সৃষ্টি হয় সেজন্য ব্যাংকিং রীতি-নীতিগুলো যথাযথ পরিপালনে জোর দিতে হবে। অর্থনীতিতে এসব ঋণ খেলাপি, সম্পদ পাচারকারীদের দাপট অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে যথাযথ উৎপাদনশীল বিকাশ সম্ভব হবে না, সম্মানজনক কর্মসংস্থান বিস্তারের সুযোগও তৈরি হবে না।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads