বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বিরাট অন্তরায় দুর্নীতি। দুর্নীতি এখন আমাদের গ্রাস করে ফেলছে। এটি যেন আজ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কেবল হতাশাজনকই নয়, জাতি হিসেবে আমাদের জন্য বিরাট লজ্জাজনকও বটে। কোথায় নেই দুর্নীতি নামক ভয়ানক দানব? আজ এদেশে দুর্নীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। যার প্রভাব বুঝতে আমাদের পণ্ডিত হতে হয় না, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায়।
ব্যাংকের টাকা লুট, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনার মান বদলে যাওয়া (২২ ক্যারেট থেকে ১৮ ক্যারেট), রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ, ক্রয়সংক্রান্ত ভুয়া ভাউচার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কর ফাঁকি, সাংগঠনিক ব্যবস্থায় অনিয়ম, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অনিয়ম, কাস্টমস, রাজস্ব, ট্রেজারি, সাবরেজিস্ট্রার ইত্যাদি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি। এক কথায় দুর্নীতি আজ যেন অপ্রতিরোধ্য। বাদ যাচ্ছে না কয়লাখনি থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়লা সরিয়ে ফেলা এবং পাথর, মাটিও। ক্রমাগত দুর্নীতির এমন মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে তা সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারাটাও অসম্ভব যেন, যা এদেশের মানুষের জীবনে অপরিসীম ভোগান্তির জন্ম দিচ্ছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। জাতীয় পর্যায়ে সরকার থেকে শুরু করে সরকার নিয়ন্ত্রিত সব ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি বিরাজমান। একটি জাতি বা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে যদি দুর্নীতির প্রবাহ ঘটে, তবে উন্নয়নের অগ্রগতির পথে চিতার গতি তো দূরের কথা, কচ্ছপের গতি পাওয়াও কঠিন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি এখন প্রকাশ্যেই হচ্ছে, তাই এমন ঘটনা ঘটছে। আজ প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতি কতটা অপ্রতিরোধ্য হলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। অভিযোগ আছে, দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ধরতে পারছে না। ফলে দুর্নীতি কমছে না। তাছাড়া সরকারের দুর্নীতি প্রতিরোধে অঙ্গীকার থাকলেও তা কার্যকর করতে দৃশ্যমান কোনো মেকানিজম বা তৎপরতা চোখে পড়ছে না। সংসদীয় কমিটিগুলোও কার্যকরভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারছে না। যদিও আমাদের মতো দারিদ্র্যক্লিষ্ট ও সমস্যা আক্রান্ত দেশের সরকার পরিচালকদের অসংখ্য বাস্তব সঙ্কট রয়েছে, আছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা। এরপরও রাষ্ট্র পরিচালনায় যদি জনকল্যাণের প্রশ্নটি সর্বাধিক গুরুত্ব পায়, তবে ধীরে হলেও সুন্দরের লক্ষ্যে পৌঁছা খুব কঠিন হবে না।
দুর্নীতি যদি অর্ধেকে নামানো যেত, তা হলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার আরো দুই থেকে আড়াই শতাংশ বেশি হতো। দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর সাধারণভাবে এর চাপ পড়ে জনসাধারণের ওপর। এখন দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয় এবং দুর্নীতি আমাদের একটি চলমান সমস্যা। সারা দেশে এটি এখন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এ দুর্নীতির কারণে বাড়ছে মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। তা ছাড়া দুর্নীতির কারণে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়, সম্পদের সুষম বণ্টন হ্রাস পায়, সামাজিক বৈষম্য বাড়ে, মানব উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ হয়, অপরাধপ্রবণতা বাড়ে, সামাজিক নৈরাজ্য, বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা মানুষ দুর্নীতির কারণে সমাজে প্রান্তিকতর অবস্থানে বসবাস করছে। শুধু দুর্নীতির কারণেই সাধারণ মানুষ সমাজে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হয়, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে।
দুর্নীতির দুঃসহ প্রভাব পড়ে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্সকে গুরুত্ব দিয়ে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে আজ এবং এখনই। কারণ উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতি যায় না। আমাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখনই শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণসহ দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তাকে কোনো রকম ছাড় দেওয়া যাবে না। শুধু আইন প্রয়োগ করে বা আইন চাপিয়ে দিয়ে দুর্নীতি দমন করা যাবে না। যদিও দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আরো বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে; কিন্তু তাতে আশানুরূপ ফল অর্জিত হয়নি আজ পর্যন্ত। সমাজ ও দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়।
লেখক : প্রাবন্ধিক