মুহাম্মাদ আবু আখতার
মানুষের শ্রেষ্ঠ মূলধন হলো তার জীবনের মহামূল্যবান সময়। যে ব্যক্তি এ মূলধন যত ভালো কাজে বিনিয়োগ করতে পারবে সে তত বেশি লাভবান হবে। পক্ষান্তরে যদি খারাপ কোনো কাজে এ মূলধন অপব্যয় করা হয় তাহলে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। আমরা অনেকেই মনে করি যে, আল্লাহতায়ালা তার লীলাখেলার জন্যই আমাদেরকেসহ এ গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। তাই ‘খাও দাও ফুর্তি করো, দুনিয়াটা মস্ত বড়’ স্লোগান তুলে মন যা চায় তাই করার দাবি করি। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আল্লাহতায়ালা এব্যাপারে বলেন, ‘আকাশ, পৃথিবী এবং এদুয়ের মধ্যে যা আছে, তা আমি খেল-তামাশার জন্য সৃষ্টি করিনি। আমি যদি খেলার উপকরণ সৃষ্টি করতে চাইতাম, তবে আমি আমার কাছে যা আছে তা দ্বারাই তা করতাম, যদি আমাকে করতে হত।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-১৬, ১৭) মানুষের জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের কাজ-কর্মের পরীক্ষা নেওয়া। আল্লাহতায়ালা এ ব্যাপারে বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্যে কাজ-কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক, আয়াত-২)
ইসলাম মানুষকে সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। অনর্থকভাবে সময় অপচয় করার ব্যাপারে কোরআন-হাদিসে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা সফলকাম মুমিনের অন্যতম গুণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা তাদের নামাজে বিনয়ী। আর যারা অনর্থক বিষয় থেকে বিমুখ।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১-৩) যারা এ দুনিয়াতে ভোগবিলাসে মশগুল হয়ে নেক আমল থেকে বিমুখ হবে তাদের আফসোসের কোনো সীমা থাকবে না। আল্লাহ তাদের ব্যাপারে বলেন, ‘সে বলবে, হায়! এ জীবনের জন্যে আমি যদি কিছু (নেকী) আগে পাঠিয়ে দিতাম!’ (সুরা ফাজর, আয়াত-২৪)
মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। তার সব আমল আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত ফেরেশতাগণ লিখিতভাবে সংরক্ষণ করছেন। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক (ফেরেশতা) নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর।’ (সুরা ইনফিতার, আয়াত : ১০-১২) এমনকী মানুষের প্রতিটি কথাবার্তাই সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদাপ্রস্তুত প্রহরী (ফেরেশতা) রয়েছে।’ (সুরা কাফ, আয়াত-১৮) কিয়ামতের দিন তার এ লিখিত আমলনামা দিয়ে বলা হবে, ‘পাঠ করো তুমি তোমার আমলনামা। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (সুরা ইসরা, আয়াত-১৪) আমলনামায় ছোট বড় কোনো নেকী ও গোনাহ হতেই খালি হবে না। তখন অপরাধীরা তাদের সব গোনাহ দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আফসোস করতে থাকবে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে, হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি। সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি জুলুম করবেন না।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত-৪৯)
এ দুনিয়াতে কেউ সামান্যতম কোনো নেক আমল করলেও তার পুরস্কার দেওয়া হবে। সুতরাং কোনো নেক আমলকে ছোট মনে করে অবহেলা করা উচিত নয়। আল্লাহতায়ালা নিজ রহমতে ছোট কোনো নেক আমলের বদৌলতেও যে কাউকে নাজাত দান করতে পারেন। পক্ষান্তরে কেউ সামান্যতম কোন পাপ কাজ করলেও তার জন্য শাস্তি পেতে হবে। তাই কোনো পাপকে ছোট মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ছোট পাপের মাধ্যমে অনেক মানুষ বড় পাপের দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সুরা যিলযাল, আয়াত- ৭, ৮)
কথায় আছে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। শয়তান মানুষের অবসর সময়কে বিভিন্ন অনর্থক কাজে কাটানোর কুপ্ররোচনা দিয়ে তাকে প্রতারিত করে। অবসর সময়ের সদ্ব্যবহারের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচতে পারে না। এ সম্পর্কে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, যে দুটোতে অধিকাংশ মানুষ প্রবঞ্চিত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৪১২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ের সদ্ব্যবহারের প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগানোর ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক লোককে উপদেশস্বরূপ বলেছেন, ‘পাঁচটি জিনিস আসার আগেই পাঁচটি জিনিসের সদ্ব্যবহার কর। ১. বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকালকে, ২. অসুস্থতা আসার আগে সুস্থতাকে, ৩. দারিদ্র্য অবস্থা আসার আগে সচ্ছলতাকে, ৪. ব্যস্ততা আসার আগে অবসরকে এবং ৫. মৃত্যু আসার আগে জীবনকে।’ (বায়হাকী, হাদিস নং-৯৭৬৭)
ইসলাম মানুষকে বৈধ ও উপকারী কাজে সময় ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে। মানুষ সাধারণত চার ধরনের কাজ করে। প্রথম প্রকার কাজ হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই লাভজনক কিংবা কোনো এক জগতের জন্য লাভজনক হলেও অন্য জগতের জন্য ক্ষতিকর নয়। যেমন নেক নিয়তে হালাল উপায়ে জীবিকা উপার্জন করা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের জন্যই লাভজনক। কিংবা কোনো বৈধ কাজ করা যা দুনিয়াতে লাভজনক হলেও আখিরাতের জন্য ক্ষতিকর নয়। অথবা আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করা যা আখিরাতের জন্য লাভজনক হলেও দুনিয়ার জন্য ক্ষতিকর নয়। এ ধরনের কাজে সময় লাগানোর প্রতি ইসলাম সবাইকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকার কাজ হচ্ছে, আখিরাতের জন্য লাভজনক কিন্তু দুনিয়ার জন্য ক্ষতিকর। সাময়িকভাবে দুনিয়ার কাজের ক্ষতি করে হলেও আখিরাতের কাজ করার ব্যাপারে ইসলামে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু স্থায়ীভাবে দুনিয়ার সব কাজ পরিত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদ অবলম্বন করতে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। যেমন সাময়িকভাবে দুনিয়াবি কাজকর্মের ব্যস্ততা ছেড়ে জামায়াতে নামাজ আদায় ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু বিয়ে না করে ইবাদতের জন্য বৈরাগ্যজীবন অবলম্বনের ব্যাপারে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। এ ব্যাপারে হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, ‘তিনজনের একটি দল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের বাড়িতে আসল। যখন তাদেরকে এ সম্পর্কে জানানো হলো, তখন তারা ইবাদতের পরিমাণ কম মনে করল এবং বলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আমাদের তুলনা হতে পারে না। কারণ, তার আগের ও পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় তাদের মধ্য হতে একজন বলল, আমি সারা জীবন রাতভর সালাত আদায় করতে থাকব। অপর একজন বলল, আমি সবসময় সাওম পালন করব এবং কখনো বাদ দেব না। অপরজন বলল, আমি নারী সংসর্গ ত্যাগ করব, কখনো বিয়ে করব না। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিকট এলেন এবং বললেন, ‘তোমরা কি ওই সব লোক যারা এমন এমন কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশি অনুগত। অথচ আমি সওম পালন করি, আবার তা থেকে বিরতও থাকি। সালাত আদায় করি এবং নিদ্রা যাই ও মেয়েদেরকে বিয়েও করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৫০৬৩)
তৃতীয় প্রকার কাজ হচ্ছে দুনিয়ার জন্য লাভজনক কিন্তু আখিরাতের জন্য ক্ষতিকর। যেমন অবৈধ উপায়ে উপার্জন করা দুনিয়ার দৃষ্টিতে লাভজনক হলেও আখিরাতে এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। চতুর্থ প্রকার কাজ হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাত কোনো জগতের জন্যই লাভজনক নয় বরং ক্ষতিকর। যেমন অনর্থক ও ক্ষতিকর কাজে সময় নষ্ট করা। ইসলাম এ দুই প্রকার কাজে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞারোপ করেছে এবং এর ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক কাজে সময়ের সদ্ব্যবহার করার তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক