মুক্তমত

ইতিহাসের নির্মম কারবালা যুদ্ধ

  • প্রকাশিত ২৩ অগাস্ট, ২০২১

নূরুদ্দীন দরজী

 

ইসলামের ইতিহাসের মহামানব বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর তিরোধানের পর যথাক্রমে হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.)-এর শাসনের অবসানে নবী দৌহিত্র হজরত ইমাম হাসান (রা.) খোলাফায়ে রাশেদিনের পঞ্চম খলিফা নির্বাচিত হন। হজরত আলী (রা.) কুফায় নিহত হলে কুফাবাসীগণ হাসান (রা.)-কে সিংহাসনে বসান। কিন্তু ইমাম হাসান (রা.) মাত্র কয়েক মাস সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে খিলাফত শাসনের অধিকারী ছিলেন। অতীব দুঃখজনক যে, দামেস্কের অধিপতি মুয়াবিয়া হাসানের বশ্যতা স্বীকার না করে নিজেকে আরব জাহানের খলিফা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, মুয়াবিয়া কুফা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। ফলে শান্তিপ্রিয় হাসান (রা.)-কেও যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে হয়। কিন্তু তিনি মুয়াবিয়ার কূটনীতির ধূম্রজালে পড়ে যান। এতে মুয়াবিয়া ইমাম হাসানকে তার বশ্যতা স্বীকারের আহ্বান জানায় এবং এক‌ই সাথে সন্ধির প্রস্তাবও পাঠায়। চতুর মুয়াবিয়া প্রচুর হুমকি-ধমকিসহ রক্তপাতের ভয় দেখায়। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম জাহানের শান্তির জন্য ইমাম হাসান (রা.) সন্ধির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। তিনি মুয়াবিয়াকে স্বীকৃতিও প্রদান করেন। এখানে হাসান (রা.) শর্ত দেন যে, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর হাসান ভ্রাতা নবীর অপর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) খলিফা হবেন। ধূর্ত মুয়াবিয়া গদির লোভে তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে যায়। এভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খলিফা হয় চতুর মুয়াবিয়া। ভবিষ্যতে ইমাম হোসেনকে খিলাফত ছেড়ে দিতে হবে ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে। তার একমাত্র চিন্তা ছিল কীভাবে নিজ উমাইয়া বংশের শাসন চিরস্থায়ী করা যায়। যেভাবেই হোক নিজের পুত্র ইয়াজিদকে ক্ষমতায় আনার জন্য বিভোর হয়ে পড়ে।

ইয়াজিদ ছিল দুশ্চরিত্রবান, মদ্যপ ও অধার্মিক। মুয়াবিয়া নিজের পুত্রের ভবিষ্যৎ পথ নিষ্কণ্টক করতে পুত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হোসেনকে হত্যা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। প্রথমেই লেগে যায় হাসান (রা.)-এর পেছনে। মন্ত্রী মারোয়ানের কুপরামর্শে এক কালনাগিনী মায়মুনাকে হাত করে। মায়মুনা ইমাম পত্নী জায়েদাকে ছলনা করে হাসান (রা.)-এর শয়নকক্ষে রাতে পানের জন্য পানিতে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যা করে। ইমাম হাসান (রা.)-এর মৃত্যুর পর মুয়াবিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা অনেক বেড়ে যায়। বিশৃঙ্খল রাজ্যে অশান্তি বাড়তেই থাকে। এদিকে মোটেই খেয়াল না করে মুয়াবিয়া ফরমান জারি করে ইয়াজিদের প্রতি বায়াতের আহ্বান জানায়। একমাত্র উমাইয়া বংশ ছাড়া বাকি সকল বংশ ও গোত্র মুয়াবিয়ার ফরমান অগ্রাহ্য করে। ধুরন্ধর মুয়াবিয়া তখন মক্কায় উপস্থিত হয়ে একটি সাধারণ সভা ডাকে। সভায় তার কুপুত্রের অনেক গুণগান করে তার পক্ষে বায়াত চায়। জনমতকে উপেক্ষা করে কৌশলে বায়াত শেষ করে দ্রুত দামেস্কে ফিরে যায়। কিছুদিন না যেতেই আজরাইল (আ.) তার দর্প শেষ করে দেন। মৃত্যুর পূর্বে শয়তান ইয়াজিদকে বলে যায়, যে-কোনোভাবেই যেন হাসান ভ্রাতা ইমাম হোসেনকে হত্যা করে নিজের পথ পরিষ্কার করে। ইয়াজিদ সদর্পে সিংহাসনে বসে। ক্ষমতা নিয়েই সে হোসেন (রা.)-কে বায়াত গ্রহণের আহ্বান জানায়। কিন্তু ধর্মকর্মে নিয়োজিত ইমাম হোসেন মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে ইয়াজিদকে নিরাপদ মনে করেননি। তিনি বায়াত গ্রহণে আপত্তি জানান। এতে ইয়াজিত ক্ষুব্ধ হয়ে হোসেনের বাসস্থান মদিনায় রক্তপাত করার হুমকি দিতে থাকে। পবিত্র মদিনা অসম্মানিত হবে ভেবে হোসেন (রা.) মক্কায় যেতে ইচ্ছে করেন। যাওয়ার পূর্ব রাতে তিনি জান্নাতুল বাকি ও নানার র‌ওজার পাশে বিনিদ্র রজনি অশ্রু বিসর্জন করেন। ইমাম মক্কায় চলে আসার পর‌ সেখানেও তিনি অশুভ চক্রান্তে তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা করেন। এদিকে কুফাবাসী দুঃশাসনে ইয়াজিদের বশ্যতা অস্বীকার করে। জনগণ হোসেন (রা.)-কে ক্ষমতায় আনার সংকল্প করে তাঁকে কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। অনেক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে হোসেন চিন্তা করেন কুফা গেলেই বুঝি ভালো হবে। কুফার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিনি চাচাতো ভাই মুসলিমকে কুফা পাঠান। অবস্থা অনুকূল মনে করে মুসলিম হোসেনকে কুফায় আসার সম্মতি দেন। মক্কা হতে কুফা প্রায় আটশ মাইল। অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ইমাম কাফেলা ইরাকে প্রবেশ করে দেখতে পায় তাঁকে আগাইয়া নিতে বা অভ্যর্থনা জানাতে কেউ আসেনি। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। আরো কিছু পথ অতিক্রম করে কুফার ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেন। ইতোমধ্যে বেঈমানের দল আগে খবর নিতে আসা মুসলিমকে হত্যা করে ফেলে। বিভিন্ন মারফত ইমাম হোসেন সংবাদ পেয়ে যান তাকে নিধন করার সকল প্রস্তুতি ইয়াজিত বাহিনী নিয়ে ফেলেছে। এমন সব সংবাদে ইমাম কাফেলা কুফার রাস্তা ত্যাগ করে অন্য পথ ধরে। যেতে যেতে কুফা হতে চল্লিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ফোরাত নদীর তীরে বিশ্রামের জন্য বিরতি নেয়। পরে তারা জানতে পারে এ স্থানের নাম কারবালা। কারবালার কথা শুনে হোসেন (রা.) খুব‌ই রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েন। কাফেলা অন্যত্র সরাতে চেষ্টা করা হয়, কিন্তু উট আর ঘোড়াগুলোকে অগ্রসর করানো গেল না। কারবালা ময়দানেই ইমাম হোসেন (রা.) শিবির স্থাপন করেন। পরের দিন দিবালোকে দেখা গেল ময়দানটি জনমানবহীন ভয়াবহ একটি বিস্তীর্ণ, তরুলতা-গাছগাছালিহীন রোদে খাঁ-খাঁ করা নিষ্ঠুর জায়গা।

ইয়াজিদের সৈন্য ইতোমধ্যে কারবালার চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। কারো বুঝতে আর বাকি নেই যুদ্ধ অনিবার্য। ইমাম বাহিনী যতটুকু সম্ভব সুরক্ষার চেষ্টা করে। এর‌ই মধ্যে হোসেন (রা.)-কে খবর পাঠানো হয় খিলাফতের আশা ত্যাগ করতে। যুদ্ধের হুমকি দেয়। ইয়াজিদের আস্ফাালন ও কথার উত্তরে শান্তিপ্রিয় হোসেন তিনটি প্রস্তাব দেন—এক, আমি যুদ্ধ করব না। আমাকে মদিনায় ফিরে যেতে দাও; দুই, অথবা অন্য কোনো দূর দেশে যেতে দাও; তিন, ইয়াজিদের সাথে আমি সাক্ষাৎ করতে চাই। পাষণ্ড পক্ষ হতে কোনো উত্তর‌ই পাওয়া যায়নি। উপরন্তু ইয়াজিদ বাহিনী হোসেন (রা.)-কে বায়াত গ্রহণের চাপ দেয়। হোসেন বলেন, ইয়াজিদ আমার আত্মীয়, আমি তার সাথে কথা বলে সফর সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে যাব। তাতেও কোনো ফল হলো না। বরঞ্চ হোসেন (রা.)-কে বন্দি করে তাঁর পবিত্র ছিন্ন শির ইয়াজিদের সম্মুখে প্রেরণের হুকুম হয়। কুখ্যাত খুনি শিমারকে ডেকে কারবালা যেতে আদেশ দেওয়া হয়। ইমাম হোসেন স্পষ্ট বুঝে গেলেন এখানে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। শত্রুপক্ষের নিকটও পরিষ্কার হলো ইমাম পক্ষ যুদ্ধ করবে। তারা তাড়াতাড়ি যুদ্ধের বদকৌশল হিসেবে ফোরাত নদীর পানির দখল নিয়ে নেয়। এতে যুদ্ধের সময় ইমাম বাহিনীর পানি পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। শত্রুরা বুঝে নেয় পানি না পেলেই হোসেন পক্ষ আত্মসমর্পণ করবে। ইয়াজিদ বাহিনী ফোরাত নদীর তীর ঘিরে রাখে। আর তখন থেকেই ইমাম শিবিরে পানির অভাবে হাহাকার পড়ে যায়। নারী ও শিশুদের ক্রন্দন আরম্ভ হয়ে যায়। এরপর এলো ১০ মহররম। আশুরার রাত্রি। আশুরার নানাবিধ তাৎপর্যের মধ্যে কারবালার মর্মস্পর্শী ঘটনাবলিও অন্যতম একটি।

শিবিরে পানির হাহাকারে নারী ও শিশুদের ক্রন্দনের মধ্যে ইমাম সঙ্গীগণকে যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে বলেন। তিনিও যুদ্ধসাজ পরিধান করেন। মাথায় বাঁধেন নবীর আমামা, গায়ে জড়ান নবী অঙ্গের জামা, কোমরে বাঁধেন ভাই হাসানের কটিবন্ধ, বগলে নেন পিতা আলীর দেওয়া তলোয়ার ও অন্যান্য যুদ্ধসাজ। দামামার সুর বেজে ওঠে। তৃষ্ণার্থ ঘোড়াগুলো বাদ্যের তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যায়। ইমাম তাঁর প্রিয় দুলদুলে স‌ওয়ার হন। ইমামকে দেখে সকল সঙ্গীর চিন্তা-ভাবনা, ক্ষুধা-তৃঞ্চা সব‌ই দূর হয়ে যায়। সবাই ঘন ঘন ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তুলে রণক্ষেত্র কাঁপিয়ে তোলে। এর‌ই মধ্যে সমঝোতার জন্য ইমাম দুলদুল ছেড়ে উটে চড়ে শত্রু শিবিরের সামনে হাজির হন। তিনি শত্রুদের উদ্দেশে বলেন, আমি রাসুলুল্লাহর নাতি, মহাবীর আলী ও মা জননী ফাতেমার ছেলে, তোমরা যে নিজ হস্তে তাঁকে কাটতে এসেছ বিশ্বাস হয় না। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। তোমাদের আমন্ত্রণে এখানে এসেছি। আমাকে হত্যা করার জন্য তোমরা কেন প্রস্তুত হয়েছ? জগৎ পিতা আল্লাহর নিকট আমার ও তোমাদের জন্য করুণা ভিক্ষা করছি। আমাকে ছাড়িয়া দাও, চলে যাই। আমাকে হত্যা করো না। পথ ছাড়, আমি আল্লাহর কাবাঘরে অথবা নানাজানের র‌ওজায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। শত্রুদের কোনো উত্তর না পেয়ে ইমাম আবার বলেন, আল্লাহর শোকর আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। ইমাম হোসেন (রা.) আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাত করে বলেন, ইয়া এলাহি, আমি সংকটাপন্ন, তুমিই আমার ভরসা, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করো। মোনাজাত শেষে উট হতে নেমে তিনি পুনরায় দুলদুলে আসীন হন এবং শত্রুপক্ষের প্রথম আঘাতের প্রতীক্ষায় থাকেন। ইয়াজিদ বাহিনীর মধ্যে কানাঘুষা চলল কে নবীর দৌহিত্রের পবিত্র শরীরে আঘাত করবে? কারো হূদয় ভেঙেও যাচ্ছিল, দয়া হচ্ছিল ইমামের পক্ষাবলম্বন করার। কিন্তু না, এতে মুহূর্তেই গর্দান চলে যাবে। শিমারের পরামর্শে প্রথম তাদের সেনাপতি ওমর হোসেন (রা.)-এর প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করে। উভয়পক্ষের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়। শুরুতে শত্রুপক্ষ ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইমাম পক্ষ হতে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান করেন। শত্রুপক্ষ রাজি না হয়ে দূর হতে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। ইমাম পক্ষ একে একে প্রতিহত করে চলে। সেদিন ছিল জুমার দিন। তাতেও শত্রপক্ষ আক্রমণে বিরতি দেয়নি। ইমামপক্ষ আগে-পিছে একে একে নামাজ পড়ে নেন। নামাজের পর দেখা গেল হোসেন (রা.)-এর পক্ষের সৈন্য প্রায় শেষ। অবশিষ্ট আছেন ইমামের কয়েকজন ভাই, কয়েকজন খেদমতগার এবং ইমাম পরিবারের সন্তানগণ মাত্র। অবশেষে একে একে সবাই শহীদ হন। ইমাম বংশের কিশোর ও যুবকগণ ব্যতীত আর কেহ র‌ইল না। ২০/২২ বছর বয়সি ভ্রাতুষ্পুত্র কাসিম সজ্জিত হয়ে অনুমতির জন্য চাচার কাছে গেলেন। মাত্র কদিন হলো হোসেনের সুন্দরী কন্যা সকিনার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছে। কাতর কণ্ঠে হোসেন বলেন, যাও বাবা! মাকে কদমবুসি করে চোখের পানিতে ভেসে নবাগত বধূর চোখে চোখ রেখে দ্রুতবেগে ময়দানে গিয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাকে দেখে ইয়াজিদের দল ভীত হয়ে পড়ে। তাদের প্রধান পালোয়ান আরজক ও ওমরসহ অনেকে পরাস্ত হলে আরজকের চার পুত্র যুদ্ধ করে নিধন হয়। এতে আরজক পাষণ্ড রূপ ধারণ করে পুনরায় কাসিমকে আঘাত করে। কাসিমের পবিত্র মস্তক মাটিতে ফেলে দেয়। পিপাসায় কাতর কাসিম বার বার পানি চায়। ইমাম শিবিরে কান্নার রোল ওঠে। সকিনা কাসেমের রক্তমাখা দেহ জড়িয়ে বিলাপ করতে থাকে। রুদ্র মূর্তি ধারণ করে কাসিমের ভাই আবদুল্লাহও তুমুল যুদ্ধ করে শহিদ হন। সর্বশেষ হোসেন (রা.) অস্ত্র ধারণ করেন। হোসেন (রা.) দুলদুলে চেপে শত্রুদের দিকে অগ্রসর হন। প্রথমে তিনি ফোরাত নদীতে গেলেন। সামনে যাকে পান তাকেই দ্বিখণ্ডিত করে নদীর কিনারায় উপস্থিত হন। শিমার বুঝে ফেলে পানি পান করে হোসেন শক্তিশালী হয়ে উঠলে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না। তিরন্দাজদের হুকুম দেয় হোসেনকে হত্যা করে ফেলতে। শিমারের হুকুমে উপর্যুপরি তীরের আঘাতে জর্জরিত রক্ত স্রোতের মধ্যে যুদ্ধ করতে করতে ইমাম হোসেন (রা.)-এর পবিত্র শরীর ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আর তখন শিমার বাছাই করা কয়েকজন পাষণ্ডকে নিয়ে একত্রে তাঁর ওপর আক্রমণ করল। তবু হোসেন আত্মরক্ষার্থে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক শত্রু পেছন দিকে আঘাত করে তাঁর বামহাত কেটে ফেলল। ইমামও প্রতিঘাতে সে শত্রুর শিরশ্ছেদ করলেন। কিন্তু তিনি দুলদুল হতে মাটিতে পড়ে গেলেন। তার পবিত্র বক্ষস্থলে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হলো। বর্শা বক্ষ ছিদ্র করে পিঠ দিয়ে বের হলো। এমন সময়ে নিষ্ঠুর শিমার ইমামের বক্ষের ওপর চড়ে বসল। আঘাতের পর আঘাত করে হোসেন (রা.)-এর পবিত্র মাথা কাটিয়া তাকে হত্যার কাজ শেষ করল। নবীর আদরের দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) শহউদ হলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)।

এখানেই শেষ নয়। যে দেহ বুকে নিয়ে নবী আদরে চুমু খেতেন, নিষ্ঠুর ইয়াজিদ বাহিনী সে আদরের ধনকে নির্মমভাবে হত্যা করে শত খণ্ডে বিভক্ত করল। এ মর্মান্তিক পরিণতিতে ইমাম শিবিরের রমণীগণের আকুল আর্তনাদ ও ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল। দিনের আলো লজ্জায় ম্লান হয়ে মুখ ঢেকে নিল। ইসলামের ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট ও ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেল। বন্দি রমণীগণকে নিয়ে শিমার কুফার উদ্দেশে র‌ওনা হলো। কুফা হতে তাদের কাফেলা দামেস্কে র‌ওনা দিল। প্রায় সাত দিনের মধ্যে ক্লান্ত, অবসন্ন ও তৃষ্ণার্ত রমণীগণকে শিরসহ দামেস্কে উপনীত করল। পাপিষ্ঠ শিমার সগর্বে হোসেন (রা.)-এর ছিন্ন শির কুখ্যাত ইয়াজিদের সম্মুখে রেখে পুরস্কারের লোভে উদগ্রীব হয়ে উঠল। ইয়াজিদ নাকি তখন এমন পবিত্র ছিন্ন মস্তক দেখে আশ্চর্য হয়ে পড়েছিল। হয়তো লোক দেখানোর অভিনয় করে সে শিমারসহ অন্যদের ভর্ৎসনা করেছে বলে শোনা যায়। কয়েকদিন পর আত্মীয়স্বজনে পরিপূর্ণ একটি কাফেলার মাত্র কয়েকজন ব্যথাভরা হূদয় ও বুকে আগুনজ্বলা রমণীগণকে নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠরা মদিনার পথে পাঠিয়ে দিল। ইসলামে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এভাবেই ইমাম হোসেন (রা.) পরিবারবর্গসহ শাহাদতবরণ করে অমর হয়ে আছেন।

 

লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads