আয়কর ও জাকাতের মধ্যে সমন্বয় সাধন প্রয়োজন

আয়কর ও জাকাত

ছবি : প্রতীকী

ফিচার

আয়কর ও জাকাতের মধ্যে সমন্বয় সাধন প্রয়োজন

  • আনোয়ার ফারুক তালুকদার
  • প্রকাশিত ১৩ মার্চ, ২০১৯

আয়কর হচ্ছে ব্যক্তি বা সত্তার আয় বা লভ্যাংশের ওপর প্রদেয় কর। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর আওতায় কর বলতে অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রদেয় আয়কর, অতিরিক্ত কর, বাড়তি লাভের কর, এতদসংক্রান্ত জরিমানা, সুদ বা আদায়যোগ্য অর্থকে বোঝায়। প্রকৃত অর্থে কর হচ্ছে রাষ্ট্রের সকল জনসাধারণের স্বার্থে রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে প্রদত্ত বাধ্যতামূলক অর্থ। করযোগ্য আয় থাকলে প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হয়। অর্থ আইন ২০১৫-এর আওতায় প্রত্যেক ব্যক্তি করদাতা (অনিবাসী বাংলাদেশিসহ), হিন্দু যৌথ পরিবার, অংশীদারি ফার্ম, ব্যক্তি সংঘ এবং আইনের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তির আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার উপরে হলে আয়কর প্রদানের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।

কিন্তু এখানে শর্ত থাকে যে— ১. মহিলা এবং ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তি করদাতার আয় ৩ লাখ টাকার উপরে হলে তিনি আয়কর প্রদানের উপযুক্ত হবেন; ২. প্রতিবন্ধী করদাতার আয় ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার উপরে হলে তিনি আয়কর প্রদানের উপযুক্ত হবেন; এবং ৩. গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয়সীমা ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকার উপরে হলে তিনি আয়কর প্রদানের উপযুক্ত হবেন। কর প্রদানের জন্য জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে দেশে আয়কর মেলা চালু হয়। প্রতি বছরই মেলার পরিধি বাড়ছে। মেলা নিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। গত বছর ১৩ নভেম্বর থেকে আটটি বিভাগীয় শহরসহ ১৬৬টি স্থানে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তাহব্যাপী আয়কর মেলা-২০১৮। করদাতাদের বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে এই আয়কর মেলা ঘিরে। এ সময় মেলা থেকে প্রায় ২ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা কর আদায় হয়েছে।

তবে আয়কর এবং জাকাত নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকের ধারণা, আয়কর দিলে জাকাত দিতে হবে না। কিন্তু বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক নয়। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে জাকাত অন্যতম। জাকাতের হিসাব যেহেতু আল্লাহর কাছে দিতে হবে, তাই এটি অনেকে না বুঝেই অবহেলা করে থাকেন। কারণ আল্লাহ তো দুনিয়ায় এর হিসাব নেন না। তবে রোজ কিয়ামতের দিন পাই পাই করে হিসাব দিতে হবে। অন্যদিকে আয়কর যেহেতু রাষ্ট্রীয় বিধান, তাই রাষ্ট্রের বিধান অমান্য করলে তার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিতে পারে বিধায় আয়কর ফাঁকি দিয়ে সহজে পার পাওয়া যায় না।

মুসলিম আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর ব্যয় নির্বাহের পর কোনো মুসলিমের কাছে যদি উদ্বৃত্ত সম্পদ থাকে, তাহলে সেখান থেকে তাকে শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত দিতে হবে। ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, আয়কর এবং জাকাত- দুটোই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। তবে পার্থক্য হচ্ছে, জাকাতের ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্র হতে হবে এবং আয়করের ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়ার বাধ্যবাধকতার কোনো বিষয় নেই। আয়কর দিতে হয় মোট আয়ের ওপর এবং জাকাত দিতে হয় মোট আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদের ওপর।

বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ড. শমসের আলী বলেন, আয়কর দিলেও জাকাত দিতে হবে। তিনি বলেছেন, একটি রাষ্ট্র যদি আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্র হয় তাহলে আয়কর এবং জাকাত— এ দুটো একসঙ্গে দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। তখন শুধু জাকাত দিলেই হতো। ‘রাষ্ট্র যদি ইসলামিক হয়, তাহলে অতিরিক্ত ইনকাম ট্যাক্স (আয়কর) দেওয়া লাগত না। সেটা আগেও দিত না।

তফাতটা হচ্ছে ওখানে’ কথাটি বললাম ড. শমসের আলীর ভাষায়। যুক্তরাষ্ট্রে জাকাত ব্যবস্থা নেই, সেখানে আছে বিভিন্ন ধরনের কর। আবার সৌদি আরবে জাকাত থাকলেও কর নেই। আর বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের করের পাশাপাশি আছে জাকাত দেওয়ার বিধানও পালন করতে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ গেজেটের জাকাত ফান্ড অর্ডিন্যান্স-১৯৮২-এর ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদের আয়কর মওকুফ কোটেশনে বলা হয়ছে, ‘ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট ১৯২২’ অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি জাকাত ফান্ডে যে পরিমাণ সম্পদের ওপর জাকাত দেবে, সে পরিমাণ সম্পদ তার আয়করের হিসেবে থেকে বাদ যাবে। শুধু তাকে সরকারি জাকাত ফান্ডের রশিদ প্রদর্শন করতে হবে অর্থাৎ সরকারি জাকাত ফান্ডে জাকাত জমা করলে আয়কর থেকে রেয়াত পাওয়া যাবে। আয়কর এবং জাকাত দুটি একই সঙ্গে থাকায় দ্বৈত করারোপ হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। আমাদের দেশের আয়করের বিধানটিকে জাকাতের বিধানের মতো করে নেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জনসাধারণ দ্বৈত করারোপ থেকে মুক্তি পেতে পারে। এটি রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের বিবেচনায় আসলে একটি উপায় নিশ্চয় বের করা যাবে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা জাকাতও দিতে চায়, একই সঙ্গে দেশের ব্যয় নির্বাহের জন্য করও দিতে চায়। আয়করের মতো জাকাত ব্যবস্থাকে একটি নিয়মের মধ্যে আনা খুব বেশি কঠিন কাজ হবে বলে মনে হয় না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ধর্ম মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় একত্রে বিশেষ কমিটি করে এর সুরাহা করতে পারে।

আয়কর যেমন রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যবহারিত হয়, তেমনি যে সমস্ত কাজে অর্থাৎ যারা জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জাকাতের আওতায় আনা যেতে পারে। আমাদের দেশ একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বিভিন্ন ভাতার মাধ্যমে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জীবিকা নির্বাহ তথা সমাজের মূলধারায় আনার ব্যবস্থা করে থাকে। এটি কিন্তু জাকাত প্রদত্ত অর্থের কাজেরই একটি অংশ। রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব নিয়ে এই কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করে, তাহলে কিন্তু জাকাত এবং আয়করের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করা সম্ভব। এ বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই আরো অনেক গবেষক ও বিজ্ঞজন আলোচনা করেছেন এবং করবেন বলে আমরা আশা করতে পারি।

আমার এ আলোচ্য বিষয়টি কোনোভাবেই ধর্মীয় মূল্যবোধকে খাটো করা বা আয়কর বিধানের সঙ্গে কোনোরূপ সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হোক এটা কাম্য নয়। জনসাধারণকে দ্বৈত করের দায়, ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রাখার মাধ্যমে যদি কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা রাখা যায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থাও অক্ষুণ্ন রেখে একটি স্বস্তিদায়ক ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।  

 

লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

anwarfaruq@yahoo.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads