মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার
উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) ১৯৫৩ সালে ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার স্বর্ণপ্রসবীনি গ্রাম বাবুনগরে জন্মগ্রহণ করেন।
হাটহাজারী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আল্লামা সূফি আজিজুর রহমান (রহ.)-এর পরশ ও বরকতধন্য এই আলেম পরিবার সারা দেশে ধর্মীয় অনুরাগ, শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ প্রসিদ্ধ। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতা ছিলেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ, মেশকাত শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তানজিমুল আশতাত-এর লেখক, হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস আল্লামা আবুল হাসান (রহ.) তার মামা বর্তমান হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। মোদ্দাকথা! পারিবারিক দিক দিয়ে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শীর্ষ আলেম ও বুজুর্গ খান্দানের সৌভাগ্যবান ব্যক্তি।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)-এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদরাসায়। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষা হাটহাজারী মাদরাসায় সম্পন্ন করেন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষার জন্য পাকিস্তানের করাচিতে প্রসিদ্ধ দীনি প্রতিষ্ঠান বিন্নুরি টাউন গমন করেন। সেখানে বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (রহ.)-এর সাহচার্যে থেকে হাদিসের ওপরে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৯৭৮ ইংরেজিতে দেশে ফিরে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের শুরুতেই নানার প্রতিষ্ঠিত বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদরাসায়! এরপর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে উপমহাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ দীনি শিক্ষা নিকেতন দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) ছিলেন ছাত্রবান্ধব শিক্ষক। সাবলীল উপস্থাপনা, মধুময় বাক্যশৈলী ও সর্ববোধগম্য দরসের (পাঠদানের) ফলে স্বল্প সময়ে তিনি ছাত্রদের মন জয় করে সকলের নিকট হয়ে উঠেন একজন আদর্শ উস্তাদ। তাঁর পাঠদানের সুখ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে মজলিসে শূরা তাঁকে হাদিসের সর্বোচ্চ কিতাব সহিহ বুখারির পাঠদানের দায়িত্ব ও সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রা.) -এর মৃত্যুর পরে হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা দিয়ে দক্ষতার সাথে দরসে নিজামির বিভিন্ন কিতাবের পাঠদান ও মাদরাসার সার্বিক উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) ছিলেন একজন আদর্শ, দক্ষ ও বিচক্ষণ আলেম। দাওয়াতের ময়দানে একজন দরদি দায়ী, সমাজসেবার ময়দানে ছিলেন জনদরদি সেবক। তিনি ছিলেন প্রজ্ঞাসম্পূর্ণ আপসহীন ও স্পষ্টভাষী। আপস শব্দ বলতে বাবুনগরীর অভিধানে কোনো শব্দ ছিল না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহল থেকে দামি ও মোটা অংকের মাধ্যমে হুজুরকে ভোলানোর চেষ্টা করা হলেও হুজুর কখনো আপস করেননি। হুজুর প্রায় সময়ই বলতেন, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলব তবুও বাতিলের সাথে আপস করব না।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বর্তমানে সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির এবং হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা পরিচালক ছিলেন। নূরানী তালিমুল কোরআন বোর্ড চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। সারা দেশে অসংখ্য মাদরাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
গত ২ বছর খুব কাছ থেকে হুজুরকে দেখেছি। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)-এর সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, মনকাড়া মুচকি হাসিতে যে কারো মন কাড়ত। তাঁর মন মননে ছিল না কোনো বিদ্বেষ। ছিল না কারো প্রতি আক্রোশ বা আক্রমণাত্মক আচরণ। প্রান্তিকতা ও হীনমন্যতার ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। চিন্তার দৈন্য থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল তাঁর অবস্থান। সত্যই আকাবীর ও আসলাফের বাস্তব নমুনা ছিলেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) প্রখর মেধা, তীক্ষ্ন দৃষ্টি, সূক্ষ্ম চিন্তা ও বহু গুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর ধৈর্য্য, কর্মদক্ষতা এবং স্থিরতা ছিল পাহাড়ের ন্যায়, পাহাড় যেমন তার আপন স্থানে অবিচল, তদ্রূপ তিনিও ধৈর্য্য ও নিজ কর্মে ছিলেন অটল। যার জলন্ত প্রমাণ, তাঁর দীনি খেদমতের সূচনা এবং শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রান্তিকতা ও চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ধৈর্য্যের সাথে দীনের খেদমতে অটল থাকা। যার নজির খুঁজে পাওয়া বিরল। তাঁর অনুপম আদর্শ ও হূদয়ের স্বচ্ছতা, সততা পথহারা পথিকদের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) লেখালেখির ময়দানেও ছিলেন যোগ্যবান লেখক। তাঁর ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে উঠেছে ইসলামের সুমহান আদর্শ। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। প্রবন্ধ নিবন্ধের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করেছেন। লেখালেখির প্রতি সবাইকে উৎসাহ দিতেন। বিশেষ করে তরুণদের প্রতি সবসময় নসিহত করতেন, কলম হাতে নেওয়া। লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত কাউকে পেলে আনন্দিত হতেন। উৎসাহিত করতেন। দোয়া করতেন। আল্লামা বাবুনগরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাটহাজারী মাদরাসার মুখপাত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। অবশেষে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) গত ১৯ আগস্ট ২০২১ ইংরেজি বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ হজরতের কবরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকাম দান করুন।
লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী মাদরাসা, চট্টগ্রাম