প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গতকাল সোমবার তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশের করা ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন এবং জামিন আবেদনের পর অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম (এসিএমএম) আসাদুজ্জামান নূরের আদালত এ আদেশ দেন।
দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলমকে বিকালে আদালতে নেওয়ার আগে রাজধানীর রমনা থানায় আইসিটি আইনে মামলা দায়ের করেন ডিবি (উত্তর) পরিদর্শক মেহেদী হাসান। মামলায় ফেসবুকে গুজব ও উসকানি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এর আগে গতকাল সকালে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ তারা ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে গেছেন। শুরুতে আটকের কারণ স্পষ্ট করে না বললেও বিকালে মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তিনিই একমাত্র আসামি।
শহিদুলকে ঢাকার হাকিম আদালতে হাজির করে গোয়েন্দা পরিদর্শক আরমান আলী রিমান্ডের আবেদন করেন। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কড়া নিরাপত্তা ও পুলিশি পাহারার মধ্যে খালি পায়ে শহিদুলকে এজলাসের সামনে আনা হয়। তার আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। এ সময় আদালতে শহিদুল আলম বলেন, আমাকে বাসা থেকে ডিবি পুলিশ অত্যাচার করেছে। আমার নাকে আঘাত করা হয়েছে। রক্ত গড়িয়ে পুরো পাঞ্জাবি ভিজে গেছে।
পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল অধিকার আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত শনি ও রোববার রাজধানীর জিগাতলা এলাকায় সংঘর্ষের বিষয়ে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফেসবুক লাইভে আসেন তিনি। আন্দোলনের বিষয়ে আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরকারের সমালোচনাও করেন। এরপর রোববার রাতেই শহিদুল আলমকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়।
দৃকের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলমকে ‘জোরপূর্বক’ তার ধানমন্ডির বাসা থেকে ‘অপহরণ করা হয়েছে’। অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ৩০ থেকে ৩৫ জন সাধারণ পোশাকের লোক নিজেদের ‘ডিবি’ পরিচয় দিয়ে শহিদুলকে বাসা থেকে নামিয়ে আনেন।
শহিদুলকে নিয়ে যাওয়ার সময় ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ফুটেজ নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীকে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়া হয় বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এ বিষয়ে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে সংবাদ সম্মেলন করেন শহিদুলের স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ। তিনি বলেন, তার স্বামীকে ‘তুলে নেওয়ার পর’ পরিবার ও আইনজীবীকে কিছু জানানো হয়নি।
এক প্রশ্নের উত্তরে রেহনুমা বলেন, ‘রোববার রাত ১টা থেকে সংবাদ সম্মেলনে আসার আগ পর্যন্ত ডিবি কার্যালয়ে ছিলাম, আমরা কিছু জানতে পারিনি। আমরা জানতে চাই, কী এমন অভিযোগে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী শিরিন হক এবং এনজিওকর্মী তাহমিনা রহমান বক্তব্য দেন।
নিঃশর্ত মুক্তি চায় সিপিজে : দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-সিপিজে। গত রোববার বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন এই সংগঠনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
সিপিজের এশিয়াবিষয়ক প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর স্টিভেন বাটলার বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই শহিদুল আলমকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। কর্তৃপক্ষের উচিত আলমসহ ঢাকার সংঘাতের খবর সংগ্রহে নিয়োজিত সব সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন তারা হামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে।’
সিপিজের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের সদস্য পরিচয় দিয়ে একদল লোক বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার এবং দৃক ও পাঠশালা মিডিয়া ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলমকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলার সময় এপির ফটো সাংবাদিকসহ অন্তত পাঁচ সংবাদকর্মীর ওপর হামলা হয়েছে।
সিপিজে জানিয়েছে, সংগঠনটির পক্ষ থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ডিএমপি কমিশনার ও ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চকে ফোন করে সাড়া পাওয়া যায়নি। ডিএমপি কমিশনারের কাছে একটি ই-মেইলও করা হয়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে ওই ই-মেইলের উত্তরও পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত কমিশনারের কাছেও ফোন করেছে সিপিজে। এক ব্যক্তি ফোনটি রিসিভ করে বলেছিলেন, তিনি গ্রেফতারের ব্যাপারে নিশ্চিত নন। এরপর ফোনটি কেটে যায়। ধানমন্ডি পুলিশ স্টেশনেও ফোন করে সাড়া পায়নি সিপিজে।