পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই গত বুধবার রাত দেড়টার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশনের ভাসানটেকের আবুল ও জাহাঙ্গীরের বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে ছিল বস্তির শ্রমজীবী মানুষ। ঘুমন্ত মানুষ আচমকা জেগেই দেখতে পায় চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। এমনকি বস্তিতে প্রবেশের একমাত্র সরু পথটিও আগুনে ছেয়ে যায়। এ অবস্থায় জীবন বাঁচাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খালে ঝাঁপ দেয় শত শত মানুষ।
ভাসানটেক বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে গেছে ৫ শতাধিক ঘর। আগুন থেকে পানিতে নেমেও বাঁচতে পারেনি তিন শিশু। মা-বাবার হাত ফসকে পানিতে ডুবে তাদের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে দুজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ একজন। রাত সোয়া ১টায় লাগা আগুন ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিটের চেষ্টায় ভোররাতে নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে বস্তির সব ঘর পুড়ে ছাই।
আগুন থেকে বাঁচতে পরিবারের সদস্য ও সন্তানদের নিয়ে বস্তির পাশের খালে ঝাঁপ দেয় অধিকাংশ মানুষ। তবে নারী, শিশু ও বৃদ্ধাদের খাল পার করতে সমস্যা হয়। বাবা-মায়ের হাত ও কোল ফসকে পানিতে ডুবে প্রাণ হারায় তিন শিশু।
পোড়া বস্তির বাসিন্দা জননী রূপা আক্তার হারিয়েছেন আড়াই বছরের ছেলে তন্ময়কে। আগুনে যখন ঘর পুড়ছিল, তখন তিনি স্বামীছনু মিয়া ও সন্তান তন্ময়কে নিয়ে খালে ঝাঁপ দেন। তখন মায়ের হাত ফসকে ডুবে যায় তন্ময়। অনেক খোঁজার পর সন্তানের লাশ পাননি তিনি। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল তন্ময়ের লাশ উদ্ধার করে।
একইভাবে খাদিজা বেগম খাল সাঁতরে তিন মাসের মেয়ে ইয়াসমিনকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। তখন কোল থেকে পড়ে হারিয়ে যায় শিশুটি। তারও লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। নিহত শিশুটির বাবার নাম নূর আলম। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায়।
ফায়ার সার্ভিসের বারিধারা স্টেশন ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শিশু দুটির লাশ উদ্ধার করি। এরপর ভাসানটেক পুলিশের কাছে লাশ হস্তান্তর করেছি।’
বিআরবি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত আক্তার (১২)। বাবা-মায়ের বড় সন্তান নুসরাত। আগুন লাগার পর বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সেও খালে ঝাঁপ দেয়। সে বাবার হাত ধরেছিল। কিন্তু খালে ঝাঁপিয়ে পড়া শত শত মানুষের হুড়াহুড়িতে নুসরাতের হাত ছুটে যায়। বাবা নজরুল ইসলাম রিকশাচালক। বস্তির আক্তারের ঘরে ভাড়া থাকতেন তারা। পাঁচ বছরের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আর মেয়েকে খুঁজে পাননি নজরুল।
ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে তখন নজরুল ইসলাম তার মেয়ের জন্য খালপাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ডুবুরি দলটিকে সম্ভাব্য জায়গা দেখিয়ে দেন তিনি। কিন্তু কোথাও খোঁজ মেলেনি নুসরাতের।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান বলেন, ‘তিনজন শিশু নিখোঁজ ছিল। আমরা দুজনের লাশ উদ্ধার করেছি। বাকি শিশুটি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ডুবুরি দল খালে কাজ করবে।
বস্তিতে প্রায় পৌনে চারশ টিনের ঘর ছিল। ডোবার ওপরে বাঁশ ও লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি করা ছোট ছোট ঘর পুড়ে ডোবার সঙ্গে মিশে গেছে। ছাই আর কয়লার ভেতরে মানুষ নিজেদের অবশিষ্ট সম্বলের খোঁজ করছেন। কেউ পোড়া টিন নিয়ে আসছেন, কেউ পোড়া থালাবাটি, লোহার খাট ছাইয়ের ভেতর থেকে টেনে তুলছেন। কেউ আবার ছাই সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছুু আছে কি না তার সন্ধান করছেন।
বস্তির বাসিন্দারা এখানে কেউ কেউ দশ বছর ধরেও আছেন। এত বছরের সঞ্চয় ও সংসার চোখের সামনেই পুড়েছে। কারো কারো নগদ টাকা, জমানো কিস্তির টাকা পুড়েছে। এমনই একজন হাবিবা। তিনি ময়মনসিংহ থেকে তিন বছর আগে ঢাকায় আসেন। এই বস্তিতে এসেই ১৫০০ টাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নেন। স্বামী ও সংসার নিয়ে তার ভালোই চলছিল। কিন্তু আগুনে তার সব শেষ। তিনি বলেন, বাড়িতে টাকা পাঠাব বলে ৯ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম। সব পুড়েছে। বাসা থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে গেছি।
১৫-১৬ জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা মিলে একটি সমবায় সমিতি করেছেন। তারা বস্তিতে ৮৭টির মতো ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু সব পুড়ে এখন ছাই। তারা পরিবার নিয়ে এখানেই থাকতেন। এদের মধ্যে একজনের নাম মো. মোতালিব। তিনি বলেন, আমার চারটি ঘর ছিল। আমি পরিবার নিয়ে এখানেই থাকি। কিন্তু আগুন আমাদের পাশ দিয়েই আগে লেগেছে। সব পুড়ে গেছে। ঘর থেকে কিছু বের করতে পারিনি। আমরা সবাই পথে বসে গেছি।
ভাসানটেক আবুলের বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরের উপ-পরিচালক নূর হাসানকে (অ্যাম্বুলেন্স) সভাপতি করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন সদস্য সচিব সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন, সদস্য মিরপুর জোনের প্রধান আনোয়ার হোসেন, মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার কুতুব উদ্দিন ও ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর ওলিউল্লাহ।