মাচায় ঝুলে আছে অসংখ্য ছোট বড় লাউ। দুর থেকে মনে হবে এইগুলো যেন তরমুজ কিংবা কুমড়া ঝুলছে। কিন্তু কাছে গেলে দেখা মিলবে এক নতুন উদ্ভাবনের। সকাল থেকেই লাউ গাছের পরিচর্যা নিয়ে যেন এক প্রকার ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরমধ্যে কেউ দেখছেন কেউবা এসে ক্রয় করছেন। এমন দৃশ্য দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের কলেজপাড়া টিএন্ডটি সংলগ্ন এলাকায়। ওই এলাকার মো. আজাদ মিয়া দেশি জাতের লাউ মালচিং পদ্ধতিতে উৎপাদন করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। ইউটিউব চ্যানেল দেখে পরিবেশবান্ধব মালচিং পদ্ধতিতে দেশি জাতের লাউ উৎপাদনের স্বপ্ন দেখে এ সফলতা তিনি পান।
বর্তমানে দেশীয় জাতের লাউ উৎপাদনে ‘মালচিং খুবই জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। আর এ পদ্ধতিতে লাউ চাষ করে তিনি এলাকায় বাজিমাত সৃষ্টি করেন। ইতিমধ্যে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন দেখতে ও পরামর্শ নিতে আসছেন। আজাদ উপজেলার সীমান্তবর্তী বাউতলা গ্রামের মৃত আব্দুল আলীমের ছেলে। পরিবারে আজাদের স্ত্রী, ১ ছেলে ১ মেয়ে রয়েছে। তাছাড়া তিনি বাড়ি সংলগ্ন জায়গার মধ্যে লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, বেগুন, টমেটোসহ নানা প্রকার শাক সবজি আধুনিক পদ্ধতিতে এ চাষ করছেন।
আজাদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, তিনি দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর প্রবাসে ছিলেন। গত ৪ বছর আগে তিনি দেশে এসেছেন। এরপর তিনি দেশে কিছু করতে কৃষির উপর তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। বাড়ি সংলগ্ন জায়গায় মধ্যে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটাতে আধুনিক পদ্ধতিতে লাল শাখ, বেগুন, করলাসহ নানা প্রজাতির সবজির আবাদ শুরু করেন। এতে তিনি ভালো সফলতা পান। এরপর থেকে সবজির চাষের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে তিনি ইউটিউব চ্যানেল থেকে পরিবেশবান্ধব মালচিং পদ্ধতিতে দেশি জাতের লাউ চাষ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জেনে লাউ চাষে তার আগ্রহ কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে তিনি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে যোগাযোগ করেন। তখন তারা এ পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন। কলেজপাড়া এলাকায় বাড়ি সংলগ্ন প্রায় ১৫ শতক জায়গার মধ্যে এ পলিথিন দিয়ে বীজতলা তৈরি করা হয়। এরপর মালচিং পেপারে মুড়িয়ে অঙ্কুরিত ৩ প্রজাতির লাউ বীজ জমিতে রোপণ করা হয়। বীজগুলো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো রাখা হয়। কারণ মোড়ানো থাকলে পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারে না। ফলে কীটনাশক ব্যবহারেরও প্রয়োজন হয় না। একই কারণে ক্ষতিকর সূর্যালোকও এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।
তিনি আর বলেন সাধারণ পদ্ধতিতে অনেক সময় বৃষ্টি হলে বীজতলা বা ক্ষেত থেকে সার ধুয়ে যায়। মালচিং পেপার দিয়ে মোড়ানো থাকায় এখানে সেই সম্ভাবনাও নেই। তার এ পদ্ধতি দেখে অনেকেই এ চাষে আগ্রহী হন ।
আধুনিক পদ্ধতিতে লাউ আবাদে জমি তৈরি, চারা, সার, বালাইনাশক, বীজ, রোপণ, জমি বেড়া দেওয়া আগাছা পরিষ্কার ও শ্রমিমসহ প্রায় ১০ হাজার টাকার উপর তার খরচ হয়। মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় তার গাছে ফলন আসে। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলছে বিকি কিনি। স্থানীয় বাজারে এক পিচ লাউ গড়ে ৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ পযর্ন্ত তিনি প্রায় ১৪ হাজার টাকার উপর লাউ বিক্রি করেছে বলে জানায়। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে এই জায়গা থেকে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ৫০ হাজার টাকার উপর লাউ বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন। আজাদ মিয়া বলেন, বর্তমানে তিনি নিজেই জমির পরিচর্যা করছেন। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করছেন। প্রতিদিন ৫০-৬০টি লাউ ক্ষেত থেকে কাটা হয়। স্থানীয় লোকজনসহ বাইরের ব্যাপারীরা ক্ষেত থেকেই লাউ কেনেন। শীতে এর চাহিদা আরো বাড়বে।
এদিকে কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, লাউএর উপকারীতা যতেষ্ট রয়েছে। লাউ’য়ে পর্যপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি, এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট আছে, জন্ডিস ও কিডনির সমস্যা দুর করে, ডায়াবেটিস রোগীদের উপকারী, পানিশুন্যতা কমায়, হৃদরোগের জন্য উপকারী, ওজন কমাতে সহায়তা করে, ঘুমের সমস্যা কমায়, হজমে সহায়তা করে, ত্বকের জন্য উপকারী, ইউরিনে সংক্রমণ কমায়, মানসিক চাপ কমানোসহ নানা উপকার রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাচায় ঝুলে আছে অসংখ্য লাউ। পাশাপাশি রয়েছে নানা প্রকারের সবজিও। চলছে পরিচর্যা। দুরদুরান্ত থেকে লোকজন আসছেন দেখতে। বিকল্প আয়ের সন্ধানে পরীক্ষামূলক এ পদ্ধতিতে লাউ চাষ করা হয়। তার দেখা দেখি অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে এ পদ্ধতি চাষ করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, এ পদ্ধতিতে লাউ চাষ করার ফলে জমিতে আগাছা কম হয়। বর্তমানে ফলন বৃদ্ধিতে লাউ চাষে কৃষকরা মালচিং পেপার ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। জমিতে লাউয়ের বীজ রোপণ করার পর মাচায় যখন লাউ গাছ ওঠে এর পর অল্প সময়ে ফুল আসতে শুরু করে। গাছে লাউ ধরার অল্প দিনে বাজারে বিক্রি করা যায়। তারা জানায় এ পদ্ধিতে লাউ চাষ খুব লাভজনক। কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই বলে চলে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা বেগম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আধুনিক প্রযুক্তিতে লাউ চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মালচিং পদ্ধতিতে লাউসহ নানা সবজি আবাদ হলেও এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ও করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে লাউ উৎপাদনে সাধারণত অন্যান্য ফসলের তুলনায় পরিশ্রম কমও ফলন ভালো হচ্ছে । এতে রাসায়নিক ও কীটনাশক সারের ব্যাবহার না থাকায় ক্ষতিকর কোন প্রভাব নেই। তাছাড়া এ লাউ সুস্বাধু ও বাজারে চাহিদা বেশি রয়েছে। বর্তমানে কৃষকরা বাজারে বিক্রিতে ভালো দাম পাচ্ছেন বলে জানায়। তিনি আরও বলেন উপজেলা কৃষি অফিস সার্বক্ষণিক কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং প্রয়োজনমতো সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে।’ বেকার যুবকরা যদি কৃষিতে এগিয়ে আসেন তবে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে উপজেলা কৃষি সবসময় প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।





