দিনকে দিন মৌলবাদের নামে উগ্রবাদ জেগে উঠছে। ইসলামকে হেফাজতের কথা বলে যে ধরনের উগ্র মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার সহিংস রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা কোনোভাবেই আর যা-ই হোক ধর্মের কর্ম হতে পারে না বরং ধর্মের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত ধর্মীয় উগ্রবাদকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব শতবর্ষের মুজিব চিরন্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতার নামে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে সারা দেশে বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যে তাণ্ডব হেফাজতে ইসলাম করেছে তা নজিরবিহীন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা কম বেশি সবারই জানা। সরকারি-বেসরকারি অফিস এমনকি যারা মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করবে, সেই থানা-পুলিশ পর্যন্ত বাদ যায়নি তাদের আক্রমণের হাত থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা কার্যালয়ে আগুন দেওয়ায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে গেছে এবং হাম, রুবেলাসহ সাত ধরনের গুরুত্বপূর্ণ টিকা পুড়ে যাওয়ায় সেখানকার কোমলমতি শিশুদের টিকা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলা করেছে। এটা কোন ইসলামের হেফাজত?
পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্প্রীতির জেলা হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ জেলা সেখানে আওয়ামী লীগের অফিস ভেঙে দিয়েছে স্থানীয় হেফাজত কর্মীরা। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর ছবি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবিতে আগুন দিয়েছে। আহত করেছে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে। এসব নারকীয় ঘটনা সরকারযন্ত্রকে কতটা নাড়া দিতে পেরেছে বা সরকার এদের মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে বা নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ প্রায় তেরো মাস ধরে বন্ধ থাকলেও খোলা ছিল কওমি মাদরাসা! ধর্মীয় এই উগ্রবাদ মোকাবিলায় সরকার কী পরিকল্পনা করছে জানি না তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, জাতির পিতার আদর্শের উত্তরসূরি কিংবা যে চেতনা নিয়ে, যে স্বপ্ন নিয়ে একদিন এ দেশের আপামর জনগণ দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের রেখে যাওয়া প্রজন্ম অথবা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান যারা এখনো বার্ধক্যকে সঙ্গী করে সোনার বাংলা দেখে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তারা আজ নির্বাক, হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অনেকেই বলছেন, এমন ধর্মান্ধ বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেননি। ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম সেই ১৯৪৭ সালে। ধর্মীয় ভাইদের শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন প্রায় ২৪ বছর সহ্য করার পর ধর্মীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে একটি স্বাধীন সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই মূলত বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। অথচ আজ বঙ্গবন্ধুর সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশে উগ্র মৌলবাদের আস্ফাালন দেখি! জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরনো শকুন।
২. বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইতিহাসের পথ ধরে ধারাবাহিক লড়াই সংগ্রামের ফসল। কোনো ধর্মীয় জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলার স্বাধীনতা আসেনি বরং নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো মানুষের রক্ত আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এসেছে লাল সবুজে পতাকা। মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার বক্তব্যের একটি অংশে বলেন, ‘আজ এই মুজিবনগরে একটি স্বাধীন জাতি জন্ম নিল। বিগত ২৪ বছর যাবৎ বাংলার মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগোতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীরা তা হতে দেয়নি। ...বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আজ যে নীরবতা অবলম্বন করছে, তার জন্য আমি গভীরভাবে দুঃখিত। আমি প্রশ্ন করতে চাই, লাখ লাখ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করাকে ইসলাম অনুমোদন করে কি? মন্দির বা গির্জা ধ্বংস করার কোনো বিধান কি ইসলামে আছে?’ প্রশ্ন করার সাথে সাথে তার বক্তব্যে দৃপ্তকণ্ঠে এটাও উচ্চারিত হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনো সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।’ (সৈয়দ নজরুল ইসলাম মহাজীবনের প্রতিকৃতি গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)। যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বাবার মতো দূরদর্শী রাজনৈতিক দর্শন থেকে একটি বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দল নয় বরং আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বা শত্রুপক্ষ হলো এই ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সব বাধাবিপত্তিকে পেছনে ঠেলে প্রতিকূল বিশ্ব পরিস্থিতিতেও যে ভারত আমাদের পাশে ছিল সমস্ত কিছু দিয়ে, ইতিহাসের নির্মোহ সেই সত্যকে অস্বীকার করে আজ যারা ভারতের বিরোধিতা করছেন, শুধু বিরোধিতা বললে ভুল হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে কেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এলেন তা নিয়ে তুলকালাম ঘটিয়ে বসলেন, আপনাদের ইতিহাসও তো জাতি জানে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আপনাদের অবস্থান কী ছিল?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা অস্বীকার করা নিমকহারামির নামান্তর। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত খুলে দিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষকে সেদিন আশ্রয় দিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত। শুধুই কি তা-ই? নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে রণাঙ্গনের যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলার কাজটিও কিন্তু এই ভারতের মাটিতেই হয়েছিল আর তাদের প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী আমাদের মুক্তিসংগ্রামে কতটা অবদান রেখেছে তা না হয় না-ই বললাম। অথচ সময়ের ব্যবধানে আমরা আজ কতটা অকৃতজ্ঞের জাতি হয়ে গেলাম আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন এলেন এই অজুহাতে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সারা দেশে আন্দোলনের নামে উনিশজন মানুষকে অকালে প্রাণ দিতে হলো। সারা বিশ্বেই আমরা দেখি কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান যদি অন্য কোনো দেশে যায় তাহলে সে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর প্রতিবাদ জানায়, কালো পতাকা প্রদর্শন করে কিংবা কোনো ডেমোনেস্ট্রেশন করে থাকে। এটা একটা গণতান্ত্রিক চর্চার মতোই হয়ে গেছে। কিন্তু আপনার স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে, যাদের সহযোগিতা ছাড়া আপনার স্বাধীনতা কত প্রলম্বিত হতো তা বলা মুশকিল এমনকি যুদ্ধকালীন আপনার যে সরকারটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছে সেই সরকারটিও তাদের সব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে ওইদেশে বসে, তাহলে আপনার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে যদি সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী আসে, আপনি কি তাকে স্বাগত জানাবেন নাকি তার সফরের বিরোধিতা করে সরকারি-বেসরকারি অফিস, রেলস্টেশন, পৌরসভা ভাঙচুর করবেন? মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলবেন? ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসার বিরোধিতা অনেক বাম রাজনৈতিক সংগঠনও করেছে কিন্তু তারা তো রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে থেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করেছে।
ইতিহাসের দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যুদ্ধ শেষ হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা পেয়েও বাঙালি অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে কখন আসবে স্বাধীনতার মহানায়ক। অবশেষে সব অপেক্ষার প্রহর ভেঙে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে দেশে এলেন। যুদ্ধকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি দেশে ফিরে আবেগাপ্লুত হলেন, কান্নায় বুক ভাসালেন। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র- এই মূলমন্ত্রকে উপজীব্য করে রচিত হলো দেশের সংবিধান। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণ আর নানা মত-পথের মানুষকে নিয়ে যখন দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে চলতে শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধু, তখনই ঘাতকদের পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় সপরিবারে। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এদেশে আবারো ধর্মীয় রাজনীতির প্রত্যাবর্তন করান পরবর্তী শাসকরা। সময়ে সময়ে ধর্মীয় দলগুলোকে প্রত্যেকেই তাদের মতো করে ব্যবহার করেছে আর ধর্মীয় দলগুলো সবসময় ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। যার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন নামে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর আজকে উগ্র মৌলবাদের আস্ফাালন দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর চেতনাশ্রিত চিত্তে অবাক বিস্ময়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে আজ উগ্র মৌলবাদের আস্ফাালন দেখি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় আজ এ কোন অশনি সংকেত?
লেখক : গা জী ম হি বু র র হ মা ন
গবেষক ও কলাম লেখক