বলা হয়ে থাকে আলপিন থেকে হেলিকপ্টার সবকিছু তৈরি হয় এই জিঞ্জিরায়। জিঞ্জিরা বলতেই নকলপ্রবণ একটি শিল্পকে বোঝানো হয়। বাস্তব সত্য হলো জিঞ্জিরা খ্যাত কেরানীগঞ্জে নকল আছে সত্যি তবে একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশকে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরিতে সক্ষমতা এনে দিয়েছে এই জিঞ্জিরা। জানা গেছে, জিঞ্জিরাকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কারখানাগুলো থেকে বছরে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদিত হয় এবং দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রফতানি হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ষাটের দশকের শেষদিকে জীবিকার সন্ধানে ফরিদপুর থেকে কিছু লোক এসে বসবাস শুরু করে বুড়িগঙ্গার তীর কেরানীগঞ্জে। ধীরে ধীরে এখানে যুক্ত হয় কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী এলাকার বিভিন্ন পেশাভিত্তিক উদ্যোক্তারা। কালপরিক্রমায় মুখর হয়ে ওঠে জিঞ্জিরার খ্যাতি। জিঞ্জিরা নকল জিনিস তৈরির সূতিকাগার বলে পরিচিত হলেও এখানে আসল ও নকল উভয় ধরনের জিনিসই তৈরি হয়। জিঞ্জিরার এসব শিল্পজাত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। কর্মসংস্থান হয়েছে লাখো মানুষের। শুধু কারিগরি জ্ঞান দিয়ে উৎপাদন করছেন নানা ধরনের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, সাশ্রয় হচ্ছে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
জিঞ্জিরার বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ঢেউটিন, স্ক্রু, নাট-বল্টু, ক্লাম, তারকাঁটা, জিআই তার, বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ডেকোরেটর সামগ্রী, ওয়াশিং টব, পিতলের বার্নার (কেরোসিন চুলা), ক্রোকারিজ, নিক্তিকাঁটা, শাটার, কেঁচি গেট, লোহার জানালা, দরজা ও অ্যালুমিনিয়ামের জগ-মগ।
অসম্ভবকে সম্ভব করে জিঞ্জিরা
অসম্ভবকে সম্ভব করছে জিঞ্জিরার দক্ষ কারিগররা, যাদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, নেই কোনো প্রশিক্ষণ। এখানে তৈরি হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ব্যাজ, হার্ডওয়্যার সামগ্রী থেকে প্রসাধন সামগ্রী, কলম, মোমসহ হাজারো আইটেম। কেরানীগঞ্জের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা অত্যন্ত দক্ষ। স্থানীয়ভাবে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ নামে খ্যাত লেখাপড়া না জানা কারিগররা বিখ্যাত সব কোম্পানির মালামাল তৈরি করছেন। জনশ্রুতি হলেও বাস্তব সত্যি হলো, পৃথিবীর যে কোনো পণ্য-যন্ত্রাংশ একবার দেখলেই তা জিঞ্জিরার ইঞ্জিনিয়াররা হুবহু বানিয়ে দিতে পারেন। এসব কারখানায় শ্যালো মেশিনের লাইনার, পিস্টন, নজেল, পাম্প, টিউবওয়েল, ট্রলি, ধান ভাঙা ও মাড়াই, আখ মাড়াইয়ের যন্ত্র, মোবাইল ফোনের ক্যাসিং, ব্যাটারি, চার্জারসহ নানা পার্টস, লেদ মেশিন, হস্তচালিত নলকূপ, চিনিকলের পিনিয়াম, ওসাকনি প্লেট, জুট মিলের স্ট্যান্ড, ব্র্যাকেট, হ্যাদার, টেক্সটাইল মিলের প্লেট, হুইল, সিমেন্ট কারখানার মিডিয়া বল, বাস-ট্রাকের গিয়ার বঙ্, লাইনার দোলনা, পাথরভাঙা মেশিনের চাকা, পুলি, বেবি-ট্যাক্সির ড্রাম, পুলি, লাইনার, হাউজিং ড্রাম, হপস, জগ, প্রেশার প্লেট এবং রিকশা-সাইকেলের সব যন্ত্রাংশ, হোফার মেশিন, সেফার মেশিন, লেদ মেশিন, ড্রিল ও গ্রেনিং মেশিনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি পুরোপুরি দেশি প্রযুক্তিতে প্রায় অর্ধেক দামে প্রস্তুত হচ্ছে জিঞ্জিরায়।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি ক্রিম সেপারেশন মেশিন চীন ও কোরিয়া থেকে আমদানি করতে খরচ পড়ে ৬০-৭০ হাজার টাকা। অথচ জিঞ্জিরায় দেশি প্রযুক্তিতে প্রস্তুতকৃত এই মেশিনটির দাম পড়ে মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
শুধু নকল নয়, সৃষ্টিতে আছে অভিনবত্ব
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত কাঁচামাল দিয়ে জিঞ্জিরার বেশিরভাগ কারখানায় তৈরি হচ্ছে দেশীয় পণ্য, রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। জিঞ্জিরার কারিগরদের কাছে ভাঙা হাঁড়ি, কাচ, ছেঁড়া জুতা, বিনষ্ট করা বোতল-প্যাকেট কোনো কিছুই ফেলনা থাকছে না। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র, উচ্ছিষ্ট হাড়হাড্ডি নিপুণ দক্ষতায় তৈরি করছে তাক লাগানো জিনিসপত্তর। বাসাবাড়ির আঙিনা, ড্রেন-ডাস্টবিন থেকে সংগৃহীত প্লাস্টিক বোতল, জুতা-স্যান্ডেল, পাইপ, ভাঙা জগ, বালতি, গামলা কাটিং মেশিনে কেটে ক্রাশিং মেশিনে গলিয়ে রঙ ও রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ‘দানা’ তৈরি করে সরবরাহ এবং তা চীন, নেপাল ও মালয়েশিয়ায় রফতানি করা হচ্ছে। আধুনিক মেশিনের সাহায্যে লোহা, স্টিলসহ অন্যান্য ধাতব খণ্ড গলিয়ে বানানো হচ্ছে দা, বঁটি, ছুরি হাঁড়ি-পাতিল, কড়াইসহ নানা পণ্য। তামা থেকে বানানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক তার। ছেঁড়া-ফাটা পোশাকের অংশগুলো থেকে ক্রাশিং করে ঝুট তুলা তৈরি হচ্ছে। ভাঙা কাচ দিয়ে তৈরি হচ্ছে হারিকেন চিমনি, বৈয়াম, বোতল আর প্রায় দুইশ মডেলের রেশমি কাচের চুড়ি, চুমকি, পুঁথি ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক খুঁটি, বাসাবাড়ির ভেন্টিলেটরে বানানো পাখির বাসা থেকে তারখণ্ড সংগ্রহ করে তৈরি হচ্ছে রকমারি শো-পিস। নারিকেলের খোল-ছোবড়া দিয়ে বিভিন্ন আকারের শো-পিস, ফুলদানি, একতারা, সিগারেটের অ্যাশট্রে, শিশুর খেলনাসহ তৈরি হচ্ছে নানা রকম পণ্য। এখানে শুধু দেখে নিজের কল্পনাশক্তির ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয় সামগ্রী। এসব স্বশিক্ষিত মেধাবী জনশক্তির কর্মনিপুণতা দেখলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।
অর্থনীতিতে নীরব ভূমিকায় জিঞ্জিরা
জাতীয় অর্থনীতিতে এই জিঞ্জিরার অবদান অনস্বীকার্য। কেরানীগঞ্জ শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬-৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। তাওয়াপট্টি, টিনপট্টি, আগানগর, বাঁশপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকার বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে বিস্তৃতি ঘটেছে দুই সহস্রাধিক ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পের। ফ্যাক্স থেকে মোবাইল ফোন পর্যন্ত সবকিছুই তৈরি হচ্ছে জিঞ্জিরায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি পাওয়ার প্রেস ভারত থেকে আমদানি করতে প্রয়োজন হয় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। অথচ এই জিঞ্জিরায় দেশীয় প্রযুক্তিতে যে পাওয়ার প্রেস তৈরি করা হয়, তার দাম পড়ে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। জিঞ্জিরায় এখন তৈরি হয় উন্নত মানের সামগ্রী। এখানকার উৎপাদিত পণ্য দেশীয় চাহিদা পূরণ করে রফতানি হয় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মিয়ানমারে। জিঞ্জিরাকে অনুসরণ করে দেশজুড়ে এরকম শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ৪০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি (বাইশিমাস) সূত্র জানায়, দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের হাল্কা প্রকৌশল শিল্পে বছরে টার্নওভার ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় আড়াইশ কোটি টাকারও বেশি। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ছয় লাখ কর্মীসহ পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৬০ লাখ লোকের ভাগ্য।
অবারিত হোক সম্ভাবনার দুয়ার
অবাক করার মতো সবাক খবর হচ্ছে- চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের যন্ত্রাংশের একচেটিয়া দখল ছিল বাংলাদেশের বাজার কিন্তু জিঞ্জিরায় তৈরি যন্ত্রাংশ সেই স্থান অনেকখানি পূরণ করেছে। তবে সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় নিজেদের তৈরি যন্ত্র-সরঞ্জামাদির গায়েও মেইড ইন চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামে সিল মেরে তা বাজারজাতে বাধ্য হচ্ছে। তাই নকলবাজ বলে দূরে না ঠেলে তাদের মেধা ও দক্ষতাকে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজে লাগালে জিঞ্জিরার হালকা প্রকৌশল শিল্পের মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। জাপান, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত সব দেশই শুরুতে হালকা প্রকৌশল খাতে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আর দেশীয় কারিগরদের দক্ষতাসহ আন্তরিক উদ্যম মিলিয়ে শিল্প বিপ্লব ঘটানো অসম্ভব নয়। এসব মেধাকে আধুনিক প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের আওতায় এনে জিঞ্জিরাকে শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়ে দেশীয় পণ্য উৎপাদনের বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
writetomukul36@gmail.com