সম্পাদকীয়

অমিত সম্ভবনার ক্ষেত্র সৌরবিদ্যুৎ

  • প্রকাশিত ২৭ অগাস্ট, ২০২১

আ .ব. ম রবিউল ইসলাম

 

বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রতিবন্ধক হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানির অভাব। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন কোন ক্ষেত্র  আবিষ্কৃত হয়নি এবং গ্যাসের বিদ্যমান মজুতও ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। এমনকি প্রাকৃতিক গ্যাসের বর্তমান যোগান চাহিদার তুলনার অনেক কম। আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন করা হলে গ্রাহক পর্যায়ে তার যে উচ্চমূল্য দাঁড়াবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীসহ সবাই উদ্বিগ্ন। উপরন্তু কয়লা নীতির অভাবে দেশে পাঁচটি খনির মধ্যে মাত্র একটি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। কয়লা আমদানির জন্য পর্যাপ্ত কাঠামোগত সুবিধা দেশে নেই।

এই পরিস্থিতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি একটি ভাল সমাধান হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে সৌরশক্তির সঙ্গে আর কোনো শক্তির উৎসের জুড়ি মেলা ভার। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর সব শক্তির মূল উৎসই সূর্য। পৃথিবীর প্রতি বর্গমিটারে সূর্য প্রায় ১ হাজার ওয়াট এনার্জি বর্ষণ করে। সূর্যের এই শক্তিকে কাজে লাগাতে মানুষ বহুকাল ধরে চেষ্টা করে আসছে। বর্তমানে আমরা সূর্যের শক্তি ধরার জন্য নানা ক্ষেত্রে সোলার সেলের ব্যবহার শুরু হয়েছে। ক্যালকুলেটর, বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা ঘোরানো, মোটরগাড়ি, পানি সেচ থেকে শুরু করে কৃত্রিম উপগ্রহের গায়ে সোলার প্যানেলের ব্যবহার শুরু হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর উৎসগুলির মধ্যে বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুতের সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া জল বায়ুবিদ্যুৎ এবং বায়োগ্যাসের সীমিত সম্ভবনা আছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের আরেকটি সুবিধা হলো এটি পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশে বিগত দুই দশকে সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির, বিশেষত সোলার বিদ্যুতের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের জ্বালানি সমস্যার একটি সমাধানে উপনীত হতে পারি।

সৌরবিদ্যুতের  প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৫৮ সালে বেলল্যব কর্তৃক মহাকাশ কার্যক্রমে। এর উদ্দেশ্য ছিল রকেটের জ্বালানির প্রয়োজনীতা হ্রাস করে এর ওজন কমানো। মহাকাশ থেকে মর্ত্যে এর ব্যবহার শুরু হয় সত্তরের দশকে ইয়েপ্পি প্রজন্মের নগরজীবন প্রত্যাখ্যান ও বিকল্প জীবনধারা অনুসরণ থেকে। তারা শহর থেকে দূরে পাহাড় ও অরণ্যে বসবাস শুরু করে এবং সেখানে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করতে থাকে। মহাকাশ থেকে ইয়েপ্পিদের হাত হয়ে বাংলাদেশের সন্দ্বীপের প্রত্যন্ত হরিসপুরে সোলার সিস্টেম এখন ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০২ সালে সন্দ্বীপ থেকে যাত্রা শুরু করে দেশে এ পযর্ন্ত ৪৫ লক্ষাধিক বাড়ি দোকানপাটে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে, ফলে দুই কোটির বেশি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এটা এক বিরাট সাফল্য।

তবে সাফল্যর হিসাবটা যত সোজা, এর যাত্রাটা তত সহজ ছিল না। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড বা ইডকলে প্রকল্পটি শুরু করতে গিয়ে অনেক বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছে। ইডকলের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছিল যে, বড় অবকাঠামো প্রকল্প অর্থায়নের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠান ইডকল কেন এত ছোট প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে? তাদের বোঝানো হয় যে একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আর সোলার হোম সিস্টেমের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই, দুটিই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। তাছাড়া সোলার হোম সিস্টেমের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না।

কিন্তু এবার সমস্যা দেখা দেয় প্রকল্পটির অর্থায়নের ব্যাপারে। বিশ্বব্যাংক প্রস্তাব দিয়ে বসে ইডকলকে সোলার সিষ্টেমের যাবতীয় সামগ্রী কিনতে হবে এবং গ্রামীণ শক্তি ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠিত কোনো সংস্থাকে সোলার হোম সিষ্টেমের সঙ্গে জড়িত করা যাবে না। এই প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিশ্বব্যাংকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ইডকলের কেন্দ্রীভূত ক্রয়ব্যবস্থায় দুর্নীতির সম্ভবনা থাকবে, সুপতিষ্ঠিত এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থা কেবল নতুন সহযোগী সংস্থা দিয়ে এ কাজ বেশি দূর এগোনো যাবে না। বিশ্বব্যাংক এই পরামশ কিছু শর্তে গ্রহণ করে। প্রথমত ভবিষ্যতে তারা সোলার হোম সিষ্টেমের মূল্য ও প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং সংশ্লিষ্টরা ব্যর্থ হলে তারা তাদের পরামর্শক পুনর্বহাল করবে। সুখের বিষয় প্রকল্প সংশিষ্টরা দুটি শর্ত উতরে যেতে সক্ষম হয়। ইউকল বিশ্বব্যাংকের ৫০ হাজার সিস্টেম স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করে এবং কয়েক মিলিয়ন ডলার কম ব্যয়ে এগুলো স্থাপনে সক্ষম হয়। এখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সোলার হোম সিষ্টেম কার্যক্রম সবচেয়ে দ্রুত ও সফল মডেল হিসাবে বিবেচিত।

সোলার হোম সিস্টেম কর্মসূচি এত দ্রুত বাস্তবায়নের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথম কারণটি হলো সৌর প্যানেলের ক্রমহ্রাসমান দাম। এই কর্মসূচি যখন শুরু করা হয়, তখন প্রতি ওয়াটপিক সোলার প্যানেলের দাম ছিল ৫ ডলার। তখন প্রতি ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ছিল ৮০ টাকার ওপরে। এখন প্যানেলের দাম ৩৫.৪৫ সেন্ট এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ১৫-১৬ টাকায় নেমে এসেছে। ভবিষ্যতে যা আরো কমবে বলে আশা করা যায়। সৌরবিদ্যুতের সাফল্যের দ্বিতীয় কারণটি হলো, ওই সময় বিশ্বব্যাপী কেরোসিন তেলের দাম হুহু করে বাড়তে থাকা। ফলে গ্রামে হারিকেন ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ব্যয় প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। সবশেষে স্বল্প বিদ্যুৎ খরচের এলইডি বাতি আবিষ্কারের ফলে একটি ছোট সিস্টেম ব্যবহার করে অনেক বেশি আলো পাওয়া সম্ভব হয়। আগে যেখানে একটি ঘর আলো করতে ১০-১১ ওয়াটের বাতি লাগতো, এখন ২-৩ ওয়াটের বাতি থেকেই একই পরিমাণ আলো পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় প্রচুর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভবনা আছে। উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক যে সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রম চলছে তাতে বছরে এই খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে আড়াই কোটি টাকারও বেশি। ৬০% বিনিয়োগ হয় সৌর প্যানেলে যার সবটাই আমদানি নির্ভর। ২৫% বিনিয়োগ হয় ব্যাটারিতে আর ১৫% আনুষঙ্গিক খুচরা যন্ত্রাংশে। ব্যাটারি ও খুচরা যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি হচ্ছে। প্যানেলও এখন দেশে তৈরি হওয়ার পথে। দেশীয় চাহিদা পূরুণ করতে পারলে পুরো বিনিয়োগটাই দেশীয় নির্ভরতায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সাশ্রয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। গ্রামীণ বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, বিভিন্ন খামার হ্যাচারি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও অনান্য প্রতিষ্ঠানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের পরিবর্তে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে বিদ্যুৎ ঘাটতি হয়তো একদিন চিরতরে দূর হবে।

বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে বলা হয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি গ্রামাঞ্চল ও উপশহর এবং শহর এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া। জ্বালানি সংশ্লিষ্ট আমদানি পণ্যের উৎস থেকে শুল্ক ও কর তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সোলার প্রযুক্তি জনপ্রিয় করতে সব ব্যাংক ও তার শাখাগুলোতে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে। আশার কথা হলো, এখন সৌরবিদ্যুৎতের মাধ্যমে সেচ ও ক্ষুদ্র কলকারখানা চালানো হচ্ছে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে সরকার দেশে সৌর সেচপাম্প বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে কৃষি অর্থনীতিতে। ভর্তুকি কমায় সরকারেরও খরচ সাশ্রয় হচ্ছে।

অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল এদেশের মানুষ একদিন। এর জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে। এখন উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। আমাদেরকে এখন সম্মিলিতভাবে সে লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads