অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারী

ছবি : বাংলাদেশের খবর

সম্পাদকীয়

অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারী

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ২৬ নভেম্বর, ২০১৮

সন্তানের জন্য মায়েদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অপেক্ষা সর্বকালে সর্বযুগে সমানভাবে স্বীকৃত ও পরীক্ষিত। মা শব্দটিই যেন ত্যাগ আর ভালোবাসার প্রতিবিম্ব। ৯ মাস ১০ দিন গর্ভ যাতনা সহ্য করে সন্তান জন্ম দেন মা। আস্তে আস্তে সন্তানটিকে বড় করে তোলেন আদরে যত্নে সোহাগে শাসনে। নিজে খেতে ভুলে যান, ঘুমাতে ভুলে যান। সন্তানের মঙ্গল চিন্তাই হয় মায়ের একমাত্র আরাধনা।

প্রতিটি মা-ই কামনা করেন একটি সুস্থ স্বাভাবিক স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সন্তান। যে সন্তান ধীরে ধীরে বড় হবে, লেখাপড়া শিখবে, চাকরি করবে; তারপর নিজের জীবন গড়ে তুলবে। ছেলেমেয়ের কাছে মায়েদের প্রত্যাশা এটুকুই থাকে। মা কখনো প্রত্যাশা করেন না ছেলে তাকে টাকা-পয়সা গাড়ি-বাড়ি দেবে বা তাকে রাজার হালে রাখবে। মা স্বপ্ন দেখেন ছেলে বড় হবে, তার নামযশ ও গাড়ি-বাড়ি হবে, সে নিজে রাজার হালে থাকবে।

ভাগ্য খারাপ হলে অনেক মায়ের সেই সুস্থ সন্তানটি আসে না। কখনো কখনো অনেকে প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক সন্তানের জননী হন। আর প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক সন্তান মানেই সংসারে বিড়ম্বনা। হয় সে সন্তান চোখে দেখে না বা কানে শোনে না কিংবা বোধশক্তি শূন্য। সবাই তাকে অবহেলার চোখে দেখলেও, ঝামেলা মনে করলেও, মা তাকে পরম আদরে বড় করে তোলেন একটু একটু করে।

প্রতিবন্ধী সে ছেলে হোক বা মেয়ে, তার জন্য এ সংসার এক কঠিন বাস্তবতা। প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়ার সুযোগ খুবই সীমিত, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। কাজও তারা করতে পারে না। সরকার প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করলেও সে ভাতা সঠিকভাবে বণ্টিত হয় না বলে অনেক অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মাট ১৫ লাখ ৪০ হাজার জন বা মোট জনসংখ্যার এক-শতাংশ প্রতিবন্ধী, কিন্তু এদের খুব কম সংখ্যকই বিয়ের সুযোগ পায়। আর যারা দু’চারজন পায়, তাদের মধ্যে শতকরা মাত্র একজন নারী বিয়ের পর মৃত্যু পর্যন্ত স্বামীর ঘর করার সুযোগ লাভ করেন। কারণ তার পক্ষে কোনো কাজকর্ম করা সম্ভব হয় না। আর প্রতিবন্ধী বিয়ে করলে সন্তান প্রতিবন্ধী হবে, এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে আজো বদ্ধমূল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটে না, এমন নয়। ফলে ধারণাটি সত্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিবন্ধী পুরুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আর যে ঘরে বা সংসারে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম নেয় সে ঘর বা সংসারকে মানুষ অভিশপ্ত বলে বিশ্বাস করে।

আমরা প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে আহা-উহু্ করি, সমাজকর্মীরা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করেন, লেখকরা বড় বড় লেখা লেখেন, কিন্তু তাদের সম্মান করি না। যারা তাদের সঙ্গে মেশেন তারা লোক দেখানো বাহবা পাওয়ার জন্য মেশেন। অথচ প্রতিবন্ধীদের কেউ খেলায় নিতে চায় না, স্কুলে ভর্তি করতে চায় না, কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। বিয়ে করতে বললে খুব নগণ্য সংখ্যক মানুষই আছে যারা তাদের বিয়ে করতে রাজি হবে। তাই প্রতিবন্ধীদের কষ্ট শুধু প্রতিবন্ধীরাই বোঝে। অন্যদের বোঝানো সম্ভব হয় না। এমনকি প্রতিবন্ধী পুরুষ ও নারীরাও নিজেদের বিয়ে করতে চায় না। তার অবশ্য সঙ্গত কারণ আছে। দুজন প্রতিবন্ধী হলে ভবিষ্যৎ তো ভয়ানক অন্ধকারাচ্ছন্ন। প্রতিবন্ধীদের বিয়ে হলে সমাজও তাদের প্রতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের প্রাইভেসি নিয়ে নানান টিপন্নি কাটা হয়। তারা যৌনজীবনে সক্ষম কি না, সন্তান জন্মদানে সক্ষম কি না— এমন নানান প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু কেউ ভাবেন না, তাদেরও জীবন আছে, সাধারণ মানুষের মতোই জৈবিক চাহিদা আছে। আবার অনেক পাষণ্ড মেয়েদের প্রতিবন্ধী অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে, সন্তান হয়েছে, তারপর সন্তানসহ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে এমন ঘটনাও আছে। অনেকে প্রতিবন্ধী মেয়ে বিয়ে করে মোটা যৌতুকের বিনিময়ে। বিয়ের পরে ত্যাগও করে। বিষয়টি যেন খুবই স্বাভাবিক, এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও এমনই।

যে শিশুটি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়, সে তো আর চিরকাল শিশু থাকে না। আস্তে আস্তে বড় হয়। তার ওজন বড়ে, খাবারের চাহিদা বাড়ে, একে একে অন্য চাহিদারও জন্ম হয়। গরিবের ঘরে যখন এমন একটি সন্তান জন্ম নেয়, তখন গরিবের ত্রাহি অবস্থা হয়।

মনে আছে বছর কয়েক আগে এমন এক প্রতিবন্ধী সন্তানের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা না করতে পেরে এক পিতা সন্তানসহ  ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। প্রতিবন্ধী সন্তানকে খেতে না দিতে পেরে সন্তানসহ মৃত্যুবরণ করলাম।’

ফজিলা বেগমের তিনটি প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নের কচুয়া গ্রামের ওমর ফারুকের স্ত্রী তিনি। স্বামী মারা গেছেন। থাকার মধ্যে আছে ভাঙাচোরা একখানা বসতবাড়ি। দুটি ছেলে আর এক মেয়ের জন্মের কয়েক বছর পর হতেই তাদের পা চিকন হতে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে পা দুটিই চিকন হয়ে অবশ হয়ে যায়। স্বামী না থাকায় আর অভাবের যন্ত্রণায় ছেলেমেয়েদের চিকিৎসাও করাতে পারেননি তিনি। তাদের চলাচলের জন্য সখীপুর কল্যাণ সমিতি থেকে তিনজনের জন্য একটা হুইল চেয়ার দিলেও সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তারা হাঁচড়ে-পিচড়ে চলে। অবশ্য চলৎশক্তিহীন পা ক্ষত-বিক্ষত হয়। তিনজনের একজন প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। পরিবারপ্রতি একজনের ভাতা পাওয়ার নিয়ম রয়েছে বলে জানা যায়! ছেলেমেয়েকে ঘরে রেখে মানুষের বাড়িতে কাজও করতে যেতে পারেন না ফজিলা। ছেলেমেয়েদের পাতে নিয়মিত ভাত তুলে দিতে পারেন না। তিনি মারা গেলে এই তিনজনের ভবিষ্যৎ কী হবে এই দুশ্চিন্তায় রাত জাগেন ফজিলা।

মোজাম্মেল হোসেন ও বিউটি বেগমের সংসারে পাঁচটি প্রতিবন্ধী সন্তান। মোজাম্মেলের দিনের আয় ২০০ টাকা। এই ২০০ টাকায় সাতজন মানুষের কী করে চলে। মোজাম্মেল মাঝে মাঝে রাগারাগি করেন। নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করেন। কিন্তু বিউটি বেগম মা। তিনি তো আর সন্তানদের ফেলে দিতে পারেন না। তিনি নিজ হাতে সন্তানদের খাওয়ান, গোসল করান। স্বপ্ন দেখেন ছেলেরা লেখাপড়া শিখবে। তার বাড়ির কাছাকাছি একটা প্রতিবন্ধী স্কুল আছে। আটোরিকশা করে ছাত্রদের নিয়ে যায় তারা। বিউটি প্রতিদিন এই পাঁচ সন্তানকে অটোতে তুলে স্কুলে নিয়ে যান আর অভুক্ত পেটে স্বপ্ন দেখেন সুখের দিনের।

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সীমান্তবর্তী মোহনপুর গ্রামের মৃত সন্তোষ চন্দ্র বর্মণের ছেলে সঞ্জয়। সঞ্জয়ের ডান হাত অচল, বাম পা দুর্বল, বাম চোখে ক্ষীণ দেখে। বাম হাত দিয়েই সব কাজ করতে হয় তাকে। কিন্তু স্বপ্ন অদম্য। বাবা নেই। ৬ কাঠার একফসলী জমি, প্রতিবন্ধী ভাতার ৬০০ টাকা আর মাছ ধরে নিজে চলে, দু’ভাইবোনকে চালায়, লেখাপড়া করায়। আর স্বপ্ন দেখে লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে প্রশাসনে চাকরি করার। জগন্নাথ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী হিসেবে নয়, সাধারণ কোটায় চান্স পেয়েছে সঞ্জয়। ভর্তি হয়েছে জগন্নাথে হিসাববিজ্ঞানে। কিন্তু প্রতিবন্ধী দরিদ্র সম্বলহীন সঞ্জয় কি পারবে পড়ালেখার খরচ চালাতে?

এমনই এক প্রতিবন্ধী হূদয়ের মা সীমা সরকার। নেত্রকোনা পৌর শহরের কুরপাড় এলাকায় পরিবারসহ বাস করেন সীমা সরকার। ছেলে হূদয়ের বয়স এখন ১৮ বছর। ছেলেবেলা থেকেই ছেলেকে লেখাপড়া শেখানোর অদম্য ইচ্ছ ছিল সীমার। তা নিয়ে অভাব অনটনের সংসারে কম ঝামেলা হয়নি। যেখানে তিন বেলার খাবারই ঠিকমতো জোটে না, সেখানে লেখাপড়ার খরচ দেবে কে? কিন্তু দমে যাননি সীমা। খেয়ে না খেয়ে ছেলের পড়ার খরচ চালিয়েছেন। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। খ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে হূদয়। কিন্তু সে যাবে কীভাবে! সে তো হাঁটতে পারে না। গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার পয়সাও নেই।  স্কুল-কলেজে তাকে কোলে করে নিয়ে গেছেন মা। এবার এই ১৮ বছর বয়সী ছেলেকে কোলে করে ঢাকা এসেছেন সীমা। তাকে কোলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে। ছেলেকে নিয়ে দোতলা তিনতলার সিঁড়ি ভেঙেছেন। আর সে ছবি ছাপা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। নজরে এসেছে বিশ্ববাসীর। মায়ের ভালোবাসা মুগ্ধ করেছে বিশ্ববাসীকে। বিবিসি প্রতিবছর বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকা প্রকাশ করে। সে তালিকায় বাংলাদেশের সীমা সরকার ৮১তম স্থান পেয়েছে। বিশ্বের ৬০টি দেশের ১৫ থেকে ৯৪ বছর বয়সী বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের নিয়ে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কন্যা চেলসি ক্লিনটন ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের সঙ্গে একই তালিকায় জায়গা পেয়েছেন সীমা। এ জয় মাতৃত্বের, এ জয় মমতার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিবন্ধী আর অটিস্টিক শিশুরা সুস্থ বাচ্চাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে পড়বে। বিদেশের মতো হুইল চেয়ার আর ট্রলি করে তাদের ঠেলে নিয়ে যাবে তাদের বন্ধুরা। কোথায় সেই ব্যবস্থা! কোথায় আমাদের সেই মানসিকতা!

ট্রলি নেই, হুইল চেয়ার নেই, ওসব কেনার সামর্থ্যও সীমার নেই। সীমার নারীত্ব আছে, মাতৃত্ব আছে, তাই কোনো ট্রলি বা হুইল চেয়ার হূদয়ের জন্য লাগে না। তার আছে মায়ের কোল। সে মা সীমা সরকার। তাই সীমা ছেলেসহ উঠে আসেন বিবিসির ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও  প্রভাবশালী নারীর তালিকায়। কিন্তু এ তালিকা কি ফেরাতে পারবে সীমা বা হূদয়ের ভাগ্য!

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads