অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষায় আলোকিত করুন

স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল প্রতিটি মানুষ সমানভাবে শিক্ষার সুযোগ পাবেন

আর্ট : রাকিব

মতামত

অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষায় আলোকিত করুন

  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই, ২০১৮

মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল প্রতিটি মানুষ সমানভাবে শিক্ষার সুযোগ পাবেন। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৪৭ বছর আগে। কিন্তু আজো শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হয়নি। বরং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। শিক্ষা অর্জনে ব্যয় বেড়েছে অনেক। যদিও সরকার শিক্ষার প্রসারে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, স্কুল ফিডিংয়ের মতো প্রকল্প চালু রেখেছে। তবু এখনো অধিকাংশ শিশুর শিক্ষাকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এর ওপর আবার অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুরা জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা জন্মই যেন আজন্ম পাপের মতো অনাদর, অযত্ন, অবহেলায় ওরা বেড়ে উঠছে। পারিবারিকভাবেও ওরা অনেকটাই বোঝা। ওদের নেই কোনো শিক্ষার সুযোগ। যদিও তাদের পড়াশোনার জন্য কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। সেখানে শিক্ষাখরচ এতই বেশি, যা সচ্ছল পরিবার ছাড়া মধ্যবিত্তের পক্ষেও নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সহযোগী পত্রিকায় অতিসম্প্রতি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে ‘অটিস্টিক শিশুশিক্ষা’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি খুবই উদ্বেগের।

প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষাব্যয় এখন অনেক বেশি, যা স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন। এমনকি মধ্যবিত্তের পক্ষেও এ ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের বিশেষ শিক্ষার সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গোটা দেশে অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ শিক্ষার জন্য কাজ করছে ৬২টি স্কুল, সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত ৫০টি, কল্যাণী ইনক্লুসিভ স্কুলের ৭টি ও সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রয়াস নামের প্রতিষ্ঠান।

সূত্রমতে, এর বাইরে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশে অটিজমকেন্দ্রিক হাজারের মতো বিশেষ স্কুল সরকারের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে। অবশ্য এসব নিয়ে সমাজসেবা অধিদফতর ও এনজিও কার্যক্রমের নিবন্ধন চলছে। যদিও ২০০৯ সালে প্রণীত প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালার আওতায় সমাজসেবা অধিদফতর এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেকে নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ বেসরকারিভাবে তো বটেই, এমনকি সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাও এক্ষেত্রে নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতাকেও উপেক্ষা করছে। ফলে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী অধিকাংশ শিশুর পক্ষে বিশেষ স্কুলের ব্যয়ভার বহন করে ভর্তি হওয়াও সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। এজন্য সরকারকে ভর্তি, বেতন, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক পরিচ্ছদ, চিকিৎসা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে নিবন্ধন গ্রহণে বাধ্যতামূলক আইনকে কার্যকর করতে হবে, নতুবা অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে কাজ করার মানসিকতাকে লালন করেও প্রকৃত অর্থে এর সুফল ভুক্তভোগীদের জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সূত্রমতে, গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করাতে এককালীন ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি জমা দিতে হচ্ছে। আবার মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ৬ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে (সূত্র : বাংলাদেশের খবর, ২ এপ্রিল ’১৮)। অথচ অধিকাংশ বিশেষ স্কুলে প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও থেরাপির কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেই। মূলত ভবনের একটি কিংবা দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েই এসব স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব, পুষ্টিহীনতা এবং উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবেই প্রতিবন্ধী শিশু জন্মগ্রহণ করছে, যাদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ের পরিবারের মানুষ। এসব পরিবারে জন্ম নেওয়া অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়ভার রাষ্ট্রের গ্রহণ করা উচিত। তাহলে প্রতিটি শিশুর মানসম্মত লেখাপড়া, চিকিৎসা যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি নিষ্পাপ এসব শিশু ভবিষ্যতে পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা না হয়ে বরং আশীর্বাদ হতে পারে। নইলে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণের কথা বলে হয়তো মুখে ফেনা তোলা সম্ভব হবে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে অবদান রাখা আদৌ সম্ভব হবে না।

অতিসম্প্রতি ১১তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অটিজম আক্রান্তরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সকল স্তরের জনগণকে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। সুস্থ মানুষকে আপনারা যেভাবে সহযোগিতা করছেন, তেমনি যারা প্রতিবন্ধী এবং অটিজমে ভুগছে তাদের প্রতিও সেভাবে সহযোগিতা করুন। তাহলে এমন সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটবে, যা সুস্থ শরীরে অনেকের পক্ষে করা সম্ভব নয় মর্মেও তিনি মন্তব্য করেন। এমনকি তিনি দেশের বিত্তশালীদের ওদের কল্যাণে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান। অটিজম এবং প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের ভাবা হতো ওরা পাপের ফসল। এখন কিন্তু সে ধারণা মানুষের মধ্যে নেই। বরং আর দশটা শিশুর মতোই ওরা জন্মগ্রহণ করে। তারা অভিশাপের কোনো ফসল নয়। যত্ন নিলে, প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিলে তারাও আর দশজনের মতোই বিকশিত হতে পারবে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। তিনি দেশ-বিদেশে ছুটে বেড়িয়েছেন অটিজমে আক্রান্তদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে। অটিজম সচেতনতা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে। অটিজম সচেতনতা ও জনস্বাস্থ্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সায়মা ওয়াজেদকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া ‘অটিজম চ্যাম্পিয়নে’র স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন ইউনেস্কোর একটি আন্তর্জাতিক বোর্ডের সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করছেন।

সূত্রমতে, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি ৯৬৩ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮ হাজার ৪০৫টি ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়েছে। আমরা চাই, অটিজম আক্রান্ত ও সবধরনের প্রতিবন্ধীর জন্য শিক্ষার দ্বার আরো প্রসারিত করা হোক। দেওয়া হোক সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। যেন আর দশজন স্বাভাবিক শিশুর মতো তারা শিক্ষা গ্রহণ করে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে।

আবদুল হাই রঞ্জু

সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads