বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৪ February ২০২১

মোদির সফরে চুক্তির আশায় তিস্তাপাড়ের ২ কোটি মানুষ


তিস্তা পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে নদীটির পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রায়। অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ। পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ৫০ বছর ধরে ভাটির বাংলাদেশ পানির জন্য আকুতি জানিয়ে এলেও তিস্তা ইস্যুতে একটুও বরফ গলেনি ভারতের।

এর মাঝেই আগামী ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সূচি চূড়ান্ত হয়েছে। এ খবরে খুশি হয়েছেন রংপুর বিভাগের চার জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তাপাড়ের ২ কোটি মানুষ। আশার আলো দেখছেন নদী বিশেষজ্ঞরাও।

নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তা নদীটি নীলফামারী জেলার খড়িবাড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৭৮৭ সালে একটি বড়  বন্যায় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিমি, তার মধ্যে ১১৫ কিমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত।

তিনি জানান, অভিন্ন এই নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন, দুপক্ষের সমঝোতা, এমনকি মানবিক আবেদন উপেক্ষা করে উজান থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করছে ভারত। ড. তুহিন বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে তিস্তার পানি প্রবাহের পরিমাণ, কোন কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে এরকম কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

অন্যদিকে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুদেশের  মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি, এই দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে খোঁড়া যুক্তি দেখায়।

ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ভারত তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দেয়। পরে ভারত এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে চরম হঠকারিতার আশ্রয় নেয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে তিস্তা হয়ে যায় মরুভূমি। আর কারণে-অকারণে বর্ষাকালে গজলডোবার গেট খুলে তিস্তায় পানি ছেড়ে দিয়ে ভারত তিস্তা তীর ও আশপাশের অর্ধকোটি মানুষকে বন্যায় বন্দি করে ফেলে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় বিপর্যস্ত এখন এই অঞ্চলের প্রকৃতিতে।

সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নদী কমিশনের সচিব পর্যায়ের সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। পরে ১৮ ও ১৯ মার্চ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বেশ কয়েক দফায় বৈঠকের পর ২০১১ সালের মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার চূড়ান্ত চুক্তি হওয়ার কথা। কিন্তু সেই সফরেও মমতার মন না গলার কারণে তিস্তা চুক্তি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কিছুই হয়নি। যদিও সে সময় মমতাকে গজলডোবা পয়েন্টের ২৫ ভাগ পাবে বাংলাদেশ আর ৭৫ ভাগ পাবে ভারত বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল ভারত। ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মমতা বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে যান। কিন্তু সে আশ্বাস আর আলোর মুখ দেখেনি।

জানা গেছে, ১৭৮৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিস্তা নদী ছিল উত্তরবঙ্গেরই প্রধান নদী। এই নদীর যৌবনা অবয়বের কারণে উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ছিল শীতল, শান্ত ও  মায়াময়। কিন্তু পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমির  কারণে  তিস্তা তীরবর্তী ও আশপাশের প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে উঠেছে। তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার বুকজুড়ে শুষ্ক মৌসুমে থাকে বালু আর বালু। অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলিয়ে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে প্রতি বছর হাজারো মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে পথে বসছে এই তিস্তায়। নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। তবুও আশা ছাড়ছে না বাংলাদেশ।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, বর্তমানে দেড় থেকে দুই হাজার কিউসেক পানি নদীতে আছে। তিস্তা নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ৪ হাজার কিউসেক পানি।  সেচ প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ মাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তায় স্বাভাবিক প্রবাহ মাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১০ হাজার কিউসেক। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের পর থেকে তিস্তায় পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়।

তিনি বলেন, এর উল্টো চিত্র বর্ষাকালে। বর্ষা এবং বন্যার পানির কারণে ব্যারেজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ফসল ও বাসাবাড়ি ঝুঁকির মুখে পড়ে। তখন ব্যারেজের ৪৪টি গেট ২৪ ঘণ্টা খুলে দিয়েও পানি সরানো সম্ভব হয় না। ফলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষক এবং কৃষি।

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘যখন প্রয়োজন তখন পানিশূন্য তিস্তা। প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পেলে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের চাষাবাদে আসবে নতুন চাঞ্চল্য, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে বিরূপ প্রভাব থেকে। তিস্তা ফিরে পাবে তার পুরোনো দিনের খরস্রোতা চিরচেনা রূপ। এতে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ স্বাবলম্বী হবেন।’

তিস্তাপাড়ে বসবাসকারী আশরাফ আলী বলেন, ‘এই নদীর কত উপ (রূপ) বাহে। নদীর ধারোত আছি ৪২ বছর। একবার এপাকে একবার ওপাকে। এমন করি করি এতদিন কাটানো। নদীত মাছ ধরি সংসার চালালোং। এলা নদীত পানি নাই। এক সময় সারা বছর পানি আছিল। এলা সুরু খাল হইচে। হাটি নদী পার হই হামরা। মাছ তো নাই। পুরে নদীত এলা আবাদ হয়।’

জহুরুল ইসলাম নামে এক  জেলে বলেন, ‘এক সময় নদীর মাছ ধরে শুঁটকি বানায় সেই শুঁটকি বাজারোত বিক্রি করি সংসার চালাইছি। এলা নদীত পানি নাই। খাওয়ার মাছ পাওয়া যায় না। হামরা যে কী কষ্ট করি থাকি সেডা হামরা জানি। হামারগুলের খোঁজ তো কাইও নেয় না। শুনছি ভারত নাকি পানি দিবে, পানি দিলে হামরা আবার মাছ ধরমের পামো। সংসার খোনা চলবার পামো।’

গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, তিস্তায় পানি না থাকায় ধান, পাট, আলুসহ বিভিন্ন ফসলি জমিতে সেচ দিতে গুনতে হয়েছে বাড়তি খরচ। কৃষকরা যারা চরে ফসল ফলায় তাদের কষ্টে চোখে পানি আসে। তারা কলসিতে করে নদী থেকে পানি এনে এনে তিস্তার চরে ফসল ফলাচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা হয়তো শ্যালো মেশিন বসিয়ে পানি দিচ্ছে। কিন্তু এতে করে বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। তিস্তায় পানি পেলে সে বাড়ি খরচ হবে না। এখানকার কৃষি এবং কৃষক উপকৃত হবে।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি দ্রুত সই এবং এই চুক্তি সম্পাদনে ভারতের কেন্দ্রীেয় সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ তিস্তা চুক্তি আমরা কোনো প্রদেশের সঙ্গে করব না, করতে চাই না। এটা দুই দেশের সরকারের সিদ্ধান্ত। অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তার চুক্তির বিষয়টি ২০১১ সালেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। তিস্তা অভিন্ন নদী। সেখানে অভিন্ন অধিকার আমাদের। যেভাবেই হোক মোদির এই সফরে সরকারকে তিস্তার বিষয়ে এজেন্ডা আনতে হবে এবং বাস্তবায়ন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১